গত এক দশকে বিশ্বের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডারে বিপুল পরিমাণে পরিমাণগত ও গুণগত বৃদ্ধি ঘটেছে। বিশেষ করে চীনের বিস্তৃত পরমাণু কর্মসূচি, রাশিয়ার পুনরুজ্জীবিত পারমাণবিক মহড়া এবং ন্যাটোর পাল্টা কৌশলগত প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। অনেকে একে ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ বলেও অভিহিত করছেন।
এ প্রেক্ষাপটে, পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলো কীভাবে, কখন, এবং কার বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে চায়- তা নিয়ে আলোচনা আবারও সামনে এসেছে। তবে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ সংক্রান্ত তথ্য এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে অতি গোপনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা মূলত সাধারণ জনগণ ও আইনপ্রণেতাদের থেকে গোপন রাখা হয়।
নিরব দ্বন্দ্বে
‘কাকে, কীভাবে, কোথায় এবং কেন’ পরমাণু অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হবে- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার সবচেয়ে গোপনীয় অংশ। এসব তথ্য সাধারণত শুধুমাত্র সামরিক সদর দপ্তর, গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলস্বরূপ, সাধারণ নাগরিক, এমনকি অনেক আইনপ্রণেতাও এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের অতিরিক্ত গোপনীয়তা অনেক সময় গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের মতো মনে হতে পারে। কারণ, এটি জনগণকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অজ্ঞ রাখে, এর ফলে তাদের জীবন ও ভবিষ্যতের ওপর চরম প্রভাব ফেলতে পারে।
যদিও নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু বিষয় গোপন রাখা অপরিহার্য, তথাপি নাগরিকদের কাছে ন্যূনতম তথ্য থাকা উচিত বলে মত দিয়েছে একাধিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ। তারা মনে করেন, নাগরিকদের জানা উচিত- তাদের শহর বা আশপাশের এলাকা পরমাণু হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু কিনা এবং দেশের কৌশলিক নীতিগুলো কি এই ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, না কি কমাচ্ছে।
আলোচনায় মুক্তি
পরমাণু অস্ত্র এবং নীতিনির্ধারণ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস (FAS) সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে তারা তুলে ধরেছে কোন দেশ কীভাবে তাদের পরমাণু লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে, গত কয়েক দশকে এই নীতিতে কী পরিবর্তন এসেছে এবং মিত্রদেশগুলোর প্রভাব কতটা।
তবে সংস্থাটি জানিয়েছে, তথ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ নয়, বরং এটি একটি সূচনা বিন্দু। ভবিষ্যতে আরও তথ্য আসলে এটি আপডেট করা হবে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে কিছুটা স্বচ্ছতা বজায় রাখে। সেখানকার পারমাণবিক নীতিমালা জনসম্মুখে আলোচিত হয় এবং গণমাধ্যম ও থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর মাধ্যমে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। ফলে বোঝা যায় কিভাবে লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন, যাচাই ও চূড়ান্তকরণ হয়।
অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলোতে এই স্বচ্ছতা প্রায় অনুপস্থিত। সেসব দেশে লক্ষ্যবস্তু নীতি নিয়ে কোনো গণচর্চা নেই। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র তৃতীয় পক্ষের গোয়েন্দা তথ্য, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার বক্তব্য এবং আনুষঙ্গিক বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করতে হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, কিছু কর্তৃত্ববাদী পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র- যেমন উত্তর কোরিয়া, নিয়মিতভাবে প্রকাশ্যে হুমকি দেয় কোন শহরে বা অঞ্চলে তারা হামলা চালাতে পারে। এগুলো মূলত প্রতিপক্ষকে হুমকি দেওয়া এবং দেশের অভ্যন্তরে জনমত প্রভাবিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে, অনেক দেশ বিশ্বাস করে, অতিরিক্ত পারমাণবিক বক্তৃতা বা হুমকি কৌশলগত স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে এবং অযথা উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
তথ্যসূত্র: ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন