সিঙ্গাপুরে তরুণদের মধ্যে অস্ত্র বহনের প্রবণতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ফ্যাশনের অংশ হিসেবে ছুরি, করাম্বিট বা অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্র বহন করছে তারা।
কেউ কেউ এসব অস্ত্র অনলাইনে কিনছে, কেউ বা বন্ধুদের দেখানোর জন্য সঙ্গে রাখছে। কিন্তু সমস্যাটা তখনই প্রকট হয়ে উঠছে, যখন তর্কাতর্কি বা ঝগড়ার সময় এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমনই এক চিত্র তুলে ধরেছেন ঝুঁকিপূর্ণ তরুণদের নিয়ে কাজ করা ‘ইমপার্ট’ চ্যারিটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারাসিম্মান তিভাসিহা মণি। সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ পেপার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
তিভাসিহা মণি বলেন, ‘গত দশ বছরে তরুণদের মধ্যে অস্ত্র বহনের প্রবণতা বেড়েছে। অনেক অস্ত্র দেখতে আকর্ষণীয়, তাই তরুণরা এগুলো কেনে, পরে ফ্যাশনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করে।’
এসব অস্ত্রের বড় অংশ পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে, টেলিগ্রাম, ফেসবুক, কারাউসেল, এমনকি শপির মতো প্ল্যাটফর্মে। এ ধরনের অনেক পণ্য সাজানো ভিডিওসহ বিক্রি হচ্ছে, যেখানে দেখানো হয় কীভাবে সেগুলো ব্যবহার করা যায়।
গত এক বছরে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর মিলেছে। গত মার্চে এক কিশোর গ্রুপ আক্রমণের সময় ফ্লিক নাইফ ব্যবহার করে অপর কিশোরকে ভয় দেখায়। এ ঘটনায় সে দাঙ্গার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
এর আগেও কিচেনার রোডের এক বিয়োগান্তক ঘটনায় ২৫ বছর বয়সী ধিনেশ বাসি নিহত হন। তার বন্ধু আমালরাজ থেভার মানিবানন বলেন, ‘ধিনেশ ছিল খুব তরুণ, তার সামনে পুরো জীবন ছিল। এখন নিজের তিন মাস বয়সী মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয়। স্কুলে যাওয়ার বয়সে এ ধরনের সহিংসতার মধ্যে সে পড়বে কি না, এটাই বড় চিন্তার বিষয়।’
সরকারি পরিসংখ্যানও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১০ থেকে ২১ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ‘অফেনসিভ ওয়েপনস অ্যাক্ট’-এর আওতায় অপরাধ বেড়েছে।
এ সময় ৯২টি ঘটনা থেকে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩৩। এসব মামলায় সাধারণত ছুরি বা ধারালো অস্ত্র বহনের অভিযোগই বেশি।
এমপি ড্যারিল ডেভিডের মতে, তরুণদের এমন আচরণের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে ভিডিও গেম আর সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া অপরিবর্তিত সহিংস কনটেন্ট। তিনি বলেন, ‘তরুণরা এখন প্রচুর তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু তাদের মানসিক পরিপক্বতা কম। এটাই ভয়াবহ এক সমন্বয়।’
নারাসিম্মান মনে করেন, গেমিং জগতের অভিজ্ঞতাই বাস্তবে সহিংসতার প্রতি তরুণদের মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলছে। গেমে অস্ত্র থাকলে জেতার সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে তরুণদের মধ্যে এমন ভাবনা তৈরি হয় যে, বাস্তবেও অস্ত্রের মাধ্যমে সমস্যা মেটানো যায়।
‘আরেকটি বড় কারণ আবেগ নিয়ন্ত্রণের অভাব। ‘এই বয়সে এক্সিকিউটিভ ফাংশনিং পুরোপুরি বিকশিত হয় না। ফলে তরুণরা বেশি আবেগপ্রবণ থাকে, হঠাৎ রাগের বশে অস্ত্র তুলে নেয়, বলেন নারাসিম্মান। শৈশবের মানসিক আঘাত ও বন্ধুদের নেতিবাচক প্রভাবও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে।’
সমাধান কী? ড্যারিল ডেভিডের মতে, তরুণদের ভয়ের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা শেখাতে হবে। সহিংসতার পথ ছেড়ে অন্য উপায়ে তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। আর নারাসিম্মানের মতে, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখানো জরুরি।
নারাসিম্মান বলেন, ‘তাদের অনেককে ছোটবেলা থেকেই বলা হয়েছে—‘ছেলে মানে কাঁদা যায় না, কঠিন হতে হবে’। ফলে তারা নিজেদের অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। এই অনুভূতিগুলো জমতে জমতে একসময় সহিংস আচরণে ফেটে পড়ে।’
সিঙ্গাপুরের এই চিত্র শুধু আইনশৃঙ্খলার উদ্বেগ নয়; বরং এটা সামাজিক, মানসিক ও পারিবারিক কাঠামোর বড় এক সংকেত। সময়মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষা, সহায়তা ও সঠিক দিকনির্দেশনা না পেলে এ সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।