ঢাকা শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

‘বহিষ্কৃত’ নেতাদের মজমায় ব্যস্ত ছিলেন হুমায়ুন কবির

সালমান ফরিদ, সিলেট
প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৫, ০৫:৪৮ এএম
হুমায়ুন কবির। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

হুমায়ূন কবির। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা। দীর্ঘ দেড় যুগের কাছাকাছি সময়ের পর দেশে এসেছিলেন সম্প্রতি। আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়ার ভয়ে আসতে পারেননি। এবার ঈদ কাটিয়েছেন দেশের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগরে। নিজে সজ্জন ও দলের কান্ডারির নিকটজন হওয়ায় রাজনৈতিক ও পারিবারিক ব্যস্ততা ছিল সীমাহীন।

তা ছাড়া ভবিষ্যতে বিএনপির টিকিটে সিলেট-২ আসনে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। ৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘদিন পরে স্বাধীনভাবে ফিরেছিলেন দেশে। করেছেন শোডাউন, চালিয়েছেন রাজনৈতিক তৎপরতা। ড. ইউনূসের ব্রিটেন সফরকে কেন্দ্র করে তারেক রহমানের ডাক পেয়ে লন্ডন ফিরে গেছেন ঈদের পরপরই।

উপস্থিত ছিলেন দেশের হাইপ্রোফাইল বৈঠকে। কিন্তু তিনি দেশ ছাড়ার পরই সিলেটে শুরু হয় সমালোচনা। এই সমালোচনার সূত্রপাত অবশ্য তিনি দেশে পা রাখার পর থেকে। আর ঈদের সময় সেই সমালোচনার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। 

তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হলেও দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ‘বহিষ্কার’ হওয়া নেতারা ছিলেন তার চারপাশ ঘিরে। প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ছায়ার মতো তারা তাকে সঙ্গ দিয়েছেন। তাদের নিয়ে তিনি শোডাউন করেছেন, ঈদ উদযাপন করেছেন। দলের তৃণমূলের নেতারা নন, বহিষ্কৃতরাই তার কাছে পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ও আশ্রয়। এমন দাবি দলের কারও কারও। 

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওসমানীনগর তথা সিলেট বিএনপিতে চলছে তোলপাড়। তারেক রহমানের বিশ্বস্ত ও উপদেষ্টা হওয়ায় বিষয়টি এত দিন হজম করেছিলেন তারা। এটি তাদের গাত্রদাহের কারণ হলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি। কিন্তু বেশি দিন তারা নীরব থাকেননি। হুমায়ুন কবির দেশ ছাড়ার পর থেকে অনেকে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, এ নিয়ে নালিশও পাঠানো হয়েছে তারেক রহমানের কাছে। বিষয়টি এখন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের মুখে মুখে।

স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দাবি, হুমায়ুন কবির লন্ডন থেকে সিলেট আসার দিন তাকে স্বাগত জানাতে এবং পরে ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতাকর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। সেখানে যাননি ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতাকর্মী।

সূত্র জানায়, গত ৪ জুন লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন তিনি। ৭ জুন বিকেলে গ্রামের বাড়ি ওসমানীনগরে আসেন তিনি। সন্ধ্যার আগে দয়ামীরে এলে তাকে ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়ে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় নিজ বাড়ি উমরপুরে নিয়ে যান যারা, তাদের বেশিসংখ্যকই ছিলেন উপজেলা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতাকর্মী।

পরে সেখানে সবার সঙ্গে তিনি ঈদের কুশল বিনিময় ও ঈদ পূনর্মিলনী সভায় অংশ নেন। এতে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে উপস্থিত ছিলেন ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া, বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গয়াছ মিয়াসহ অনেকেই। তারা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন।

ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী জানান, তারেক রহমানের নির্দেশ অমান্য করে দলের দুঃসময়ে যেসব নেতা-কর্মী দলের সঙ্গে বেইমানি করেছেন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে বিগত দিনে নির্বাচন করেছেন, পরবর্তীতে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় সেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় না রাখায় এবং তাদের সংবর্ধনা নেওয়ায় মর্মাহত হন উপজেলা বিএনপির শীর্ষ নেতারা। সে জন্য তারা হুমায়ুন কবিরের ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানে অংশ নেননি।

এ ঘটনার পর উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অনেকেই। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে মন্তব্যও করেন। ৯ জুন রাতে ক্ষোভ প্রকাশ করে উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জুয়েব আহমদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একটি পোস্ট করেন।

তিনি লেখেন, ‘হুমায়ুন কবির সাহেব, আপনি সব বহিষ্কৃত নেতার সঙ্গে নিয়ে ঈদ উদযাপন করছেন। আপনার আশপাশে সব বহিষ্কৃত নেতারা, তাহলে আপনি নিজেই তো তারেক রহমানের নির্দেশ অমান্য করছেন। আপনি কী উপদেশ দিবেন আর দলের জন্য কী ভালো কাজ করবেন, সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

যদি আপনি রাজনীতিবিদ হতেন, তাহলে অবশ্যই উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঈদ উদযাপন অনুষ্ঠান করতেন। আপনি তারেক রহমান সাহেবের নির্দেশ পালন করতে এসেছেন বলে দলের নেতাকর্মীদের ধোঁকা দেবেন, দলের নেতাকর্মীরা এতটা বোকা না।’ তবে জুয়েব পোস্ট করার ১০ মিনিট পর তা সরিয়ে নেন।

ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রায়হান আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, দলের বহিষ্কৃতদের সঙ্গে নিয়ে কোনো আয়োজনে আমাদের থাকার কথা নয়। আমাদের শীর্ষ অনেক নেতাও সেখানে ছিলেন। তবে আমরা আমাদের নেতা তারেক রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী দলের প্রতি আনুগত্য পালন করেছি। 

ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ মিছবাহ বলেন, আমি সেদিন উপস্থিত ছিলাম না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি ওখানে কারা উপস্থিত ছিলেন। এলাকার মানুষ হিসেবে হয়তো তারা আমাদের কৃতি সন্তান হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেটি দলীয় কোনো অনুষ্ঠান ছিল না, ছিল ব্যক্তিগত।

তাই যে কেউ যেতেও পারেন। কিন্তু তিনি যেহেতু দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাই সেই দৃশ্য দেখে আমার মতে দলের অনেকেই মর্মাহত হয়েছেন, আঘাত পেয়েছেন। দলের প্রতি যারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আন্তরিক, এটি তাদের জন্য স্বাভাবিক। তারা পাবেন। 

এদিকে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশ দাবি করে, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তারা ছিলেন ওসমানীনগর বিএনপির প্রাণ। তাদের বহিষ্কারাদেশ অনেকে মেনেও নিতে পারেননি। তারা অভিমানে পরে দলের কর্মকাণ্ড থেকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

তাদের দাবি, দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে তারা শাস্তি পেয়েছিলেন। তারা এখন দলে ফিরতেও চাইছেন। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ মিছবাহ বলেন, দল শাস্তি দিয়েছিল তারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিলেন বলেই। এখন তারা যদি সংশোধন হয়ে যান এবং দলও যদি মনে করে তাদের ক্ষমা করে দিয়ে আবার সুযোগ দেবে, তাহলে সেটি দলের সিদ্ধান্ত। আমরা দলের যে কোনো সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।