ছোট্ট মেয়ে তুবা। স্কুল থেকে একটি চিঠি লিখে এনেছিল। বিষয় ছিল- ‘বাবার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি’। শিশুসুলভ হাতে আঁকা ভালোবাসার কাঁচা লাইনগুলোয় সে লিখেছিল- ‘বাবা, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, তুমি আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
কিন্তু এই চিঠিটি আর কোনোদিন পড়তে পারেননি তুবার বাবা রিয়াজুল ইসলাম। কারণ, তুবার সেই প্রিয় মানুষটি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
বরগুনার বালিয়াতলী ইউনিয়নের উরবুনিয়া গ্রামের সন্তান রিয়াজুল ইসলাম ছিলেন পোশাকশিল্পে কর্মরত একজন পরিশ্রমী ডিজাইনার। ঢাকার সাভারে প্রীতি গ্রুপে কাজ করতেন। পরিবারসহ রাজধানীতেই থাকতেন তিনি।
কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। শুধু দেশের জন্য, একটি ভবিষ্যৎবান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নে গণআন্দোলনের বিজয়ের দিন মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন- আর সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
সেদিন ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত স্ত্রী মরিয়ম মোবাইলে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি তো আগের রাতে বলেছিলেন, কাল ছুটি- মিছিলে যাব। আমি ভেবেছিলাম, মিছিল শেষে বাড়ি ফিরে একসাথে আমরা বিজয় উদযাপন করব।
কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় একটি অজ্ঞাত লাশের খবরে স্তব্ধ হয়ে যায় সময়। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ এক পুরুষের মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মরিয়ম- এটাই ছিল তার স্বামী রিয়াজুল।
রিয়াজুল ইসলাম ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর পুরো সংসার যেন রেলচ্যুত হয়ে যায়।
একদিকে প্রতিবন্ধী শাশুড়ি, অন্যদিকে ছোট্ট কন্যা তুবা, স্ত্রী মরিয়ম কোনো কাজ পান না, সংসার চালানোর মতো সামর্থ্য নেই।
মরিয়ম বলেন, ‘আমার স্বামী কোনো রাজনীতিতে ছিলেন না। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে রাস্তায় নেমেছিলেন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন, তার মেয়ের ভবিষ্যৎটা একটু ভালো হোক। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ ধূলিসাৎ। আমার মেয়ে তুবা রাতে ঘুমাতে চায় না। বলে- ‘বাবা তো আমাকে কোলে নিয়ে ঘুমাতো।’
তুবা এখনো প্রতিদিন বাবার শার্ট গায়ে জড়িয়ে রাখে। দেয়ালে বাবার ছোট্ট হাতে আঁকা ছবি টাঙানো। ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন বলে, ‘বাবা, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না…’
মরিয়ম আরও বলেন, ‘আমার স্বামী দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। আমি চাই তাকে রাষ্ট্রীয় শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক। সেইসঙ্গে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ যাতে অনিশ্চিত না হয়, সে জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। আমরা কিছু চাই না—শুধু চাই, তুবার চোখে বাবার অভাব যেন আর কোনোদিন না পড়ে।’
আপনার মতামত লিখুন :