রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিজের শরীর ঝলসে গেলেও বিপদের মুখেই সন্তানের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী (৪২)। অবশেষে তিনিও গতকাল রাতে নাফেরা দেশে পাড়ি জমান। তবে শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধের অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করে গেলেন এই শিক্ষিকা।
ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় গতকাল রাতে মারা যান মাহরিন চৌধুরী। তার শরীরের ১০০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল বলে আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান জানান। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে স্বামী মনছুর হেলালের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়েছিল।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেলে নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ী এলাকার রাজারহাট চৌধুরী পাড়ায় নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের সামনে সেসব কথা তুলে ধরেন তিনি।
‘মাঝরাতে হাসপাতালের আইসিইউতে মাহরিনের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। এ সময় আমার হাত তার নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলেছিল, তোমার সঙ্গে আর বুঝি দেখা হবে না!’, চাপা কান্নার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন মনছুর হেলাল।
মনছুর হেলাল জানান, ক্লাস শেষে মাহরিন চৌধুরী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হওয়ার সময় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় তিনি সামান্য আঘাত পান। কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পান, ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী ভেতরে আটকা পড়ে গেছে। তাদেরকে উদ্ধারে তিনি ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করেন। এমন সময় আবার বিধ্বস্ত বিমানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
মাহরিন চৌধুরী নীলফামারীর জলঢাকার মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে ও জলঢাকা বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি। দুই মাস আগে এই দায়িত্ব নেন। তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হয়েছেন। তবে বাবার জন্মস্থানে তিনি বারবার এসেছেন এবং দাদুবাড়িতে রাত কাটিয়েছেন। এ সময় গ্রামের মানুষদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
মাহরিন চৌধুরীর খালাতো ভাই ঢাকায় দৈনিক জনকণ্ঠে কর্মরত সংবাদকর্মী রুমি চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মাহরিনের বাবা মহিতুর রহমান চৌধুরী ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই। জলঢাকার এ বাড়িতে জিয়াউর রহমান বেশ কয়েকবার এসেছিলেন।’
মাহরিন চৌধুরী সব সময় এলাকার গরিব মানুষদের খোঁজখবর নিতেন, সামর্থ্য অনুয়ায়ী আর্থিক সহযোগিতা করতেন।
তাদের এক প্রতিবেশী বলেন, দুই ঈদ ছাড়াও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন মাহরিন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন। ফলে শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।
মাহরিন চৌধুরীকে নিয়ে ফেসবুকে স্মৃতিচারণা করেন তার বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠী আলী আহমেদ মাবরুর। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাহরিন আপা আমার মানারাতের সহপাঠী ছিলেন। আমরা একই সঙ্গে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্স করেছিলাম। বয়সে আমার একটু সিনিয়র হবেন। বনেদি ঘরের মানুষ, তবে একদম সাদামাটাভাবে চলাফেরা করতেন। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তিনি উত্তরায় থাকতেন, সে হিসেবে আমার প্রতিবেশীও। উত্তরায় যখন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ছিল, বেশির ভাগ অংশই যখন জলাভূমি ও গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ, তখন থেকে এই এলাকায় তাদের বসতি।
গত কয়েক বছরে প্রথমে বাবা এবং পরে মাকে হারান মাহরিন চৌধুরী। সেই তথ্য তুলে ধরে মাবরুর লিখেছেন, ‘পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সকল ভাই-বোন বরাবরই তাকে অভিভাবক হিসেবে গণ্য করতেন। তার দুই ছেলে। ওরাও বড় হয়ে গেছে।’
তিনি আরও লিখেন, ‘মাহরিন আপা অনেক বছর যাবৎ মাইলস্টোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাখায় তারা কাজে লাগিয়েছে। আপা এখন সিনিয়র টিচার। সেই হিসেবে বাড়তি কিছু দায়িত্বও ছিল তার দিয়াবাড়ি শাখায়। গতকাল যখন স্কুলের ওপর বিমানটি আছড়ে পড়ে, তিনি তার স্বভাবসুলভ মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নিশ্চিত আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে ২০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি সেভ করেছেন। কিন্তু এই সাহসী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কখন নিজের জীবনকেই বিপন্ন করে ফেলেছেন, তা হয়তো তিনি বুঝতেও পারেননি।
দুর্ঘটনার পরই তার সঙ্গে পরিবারের সবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যরাতে তার লাশ যখন বাসায় আনা হয়, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। ওনার স্বামী আমাকে দেখে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন, ‘জানিস, তোর আপা পরশু রাতেও তোর কথা বলেছিল।’
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের ভবনে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতলে ভর্তি আছেন ১৬৫ জন।
আপনার মতামত লিখুন :