জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিওকে এক সাক্ষাৎকার দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে সাংবাদিক মেহদি হাসানের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অনেক মানুষ বলছে, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। মানুষ এই ধরনের কথা বলছে। তারা বলছে আপনি ক্ষমতায় থাকুন— নির্বাচনের কী দরকার!
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ৩৪ মিনিটের পুরো সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে জিটিও।
অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে কেন ১৮ মাস সময় লাগছে, সাংবাদিক মেহদি হাসানের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আপনি বলছেন, আমরা কেন নির্বাচন দিতে অনেক সময় নিচ্ছি? অনেক মানুষ তো বলছে, ‘৫ বছর ক্ষমতায় থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন’—মানুষ এই ধরনের কথা বলছে—তারা বলছে, ‘আপনি ক্ষমতায় থাকুন। নির্বাচনের কী দরকার!’”
সাক্ষাৎকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া, শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা ও নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ড. ইউনূস। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো:
সাক্ষাৎকারে মেহদি হাসান জানতে চান, ‘ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে, গত গ্রীষ্মে ছাত্র আন্দোলনে হাসিনার দমনমূলক পদক্ষেপে আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। অবশ্যই আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন যে, তিনি ভারতে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। সেখানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুরক্ষায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য আপনি বারবার অনুরোধ করেছেন। জবাবদিহির জন্য তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিতে আপনার আহ্বান মোদি উপেক্ষা করায় আপনি কী করেছেন? আপনি কি বিশ্বাস করেন, ভারত কখনো হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে?’
অধ্যাপক ইউনূস: তারা যদি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সম্ভবত তারা তাকে রেখে দেবে। যদি আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে থাকে, যা তারা এড়াতে পারবে না, তখন পরিস্থিতিটা ভিন্ন হবে।
মেহদি হাসান: তাকে রাখার পেছনে ভারতের স্বার্থ কী?
ড. ইউনূস: তারা বরাবরই তাকে সমর্থন করে আসছে। যারা তার পেছনে আছে, তারা সম্ভবত এখনো আশা করছে যে তিনি পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে ফিরছেন।
মেহদি হাসান: নিউইয়র্ক টাইমস খবর প্রকাশ করেছে যে, তিনি (শেখ হাসিনা) আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভার্চুয়্যাল বৈঠক করছেন। এটা কি আপনাকে উদ্বিগ্ন করে যে, ভারত তাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে এবং আবার ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টার করছে?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি ঠিক এভাবে কথাগুলো বলব না। তবে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, বাইরের কিছু শক্তি তাকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। আমরা সবসময় এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
মেহদি হাসান: আপনি কি মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি মোদির সঙ্গে কথা বলেছি।
মেহদি হাসান: আপনি যখন তাকে (শেখ হাসিনা) বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ফিরিয়ে দিতে বললেন, তখন তিনি (মোদি) কী বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: দুটি বিষয়। প্রথমত, আমি বলেছিলাম, ‘আপনারা যদি তাকে রাখতে চান তার সঙ্গে কী করবেন তা আমি আপনাকে বলতে পারি না। তবে এটা নিশ্চিত করেন যে, তিনি আমাদের সম্পর্কে কথা বলবেন না। তিনি যেন বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে কথা না বলেন।’
মেহদি হাসান: দুঃখিত, মোদি আপনাকে এ কথা বলেছিলেন, নাকি আপনি তাকে বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমি মোদিকে বলেছিলাম। বলেছিলাম যে অনুগ্রহ করে নিশ্চিত করেন।
মেহদি হাসান: তিনি কী বলেছিলেন?
অধ্যাপক ইউনূস: তিনি বলছিলেন, ‘আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।’
মেহদি হাসান: হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপনার সরকার তার সাবেক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে, তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে, কার্যত পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। আপনার মতোই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন, যিনি আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এটা পূর্ববর্তী সরকারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যারা ক্ষমতায় এসে তাদের বিরোধীদের নিষিদ্ধ করেছিল। আপনি কেবল সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছেন। অমর্ত্য সেন ও অন্যদের এ ধরনের সমালোচনার কী জবাব দেবেন আপনি?
অধ্যাপক ইউনূস: এটা ভুল সমালোচনা। কারণ আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি।
মেহদি হাসান: আমি বলছি, আপনি তো নিবন্ধন স্থগিত করেছেন?
অধ্যাপক ইউনূস: না, নিবন্ধন নয়। শুধু তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
মেহদি হাসান: এর অর্থ কী?
অধ্যাপক ইউনূস: এর অর্থ হলো, তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারে না।
মেহদি হাসান: তাহলে আপনি মূলত, আমি বলছি, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না।
অধ্যাপক ইউনূস: না, না। দলটি এখনো আছে।
মেহদি হাসান: তারা কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
অধ্যাপক ইউনূস: না এখন পারবে না। তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।
মেহদি হাসান: ঠিক আছে, তাহলে এটা কীভাবে... তারা কি দল হিসেবে বৈধ?
অধ্যাপক ইউনূস: আচ্ছা, তারা দল হিসেবে বৈধ। তবে এখন কার্যক্রম স্থগিত। যেকোনো সময় এর কার্যক্রম চালু করা হতে পারে।
মেহদি হাসান: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি স্থগিতাদেশ তুলে নিতে পারেন?
অধ্যাপক ইউনূস: স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া। এটা একটা সম্ভাবনা।
মেহদি হাসান: তাহলে আপনি দলটিকে নিষিদ্ধ করেননি। আপনি শুধু বলেছেন, এখনকার জন্য তোমরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছ না।
অধ্যাপক ইউনূস: এটা ঠিক।
মেহদি হাসান: কিন্তু একটি গোষ্ঠীর মানুষকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করাটা কতটা গণতান্ত্রিক?
অধ্যাপক ইউনূস: দেখুন, নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এটা করেছে দলটির চরিত্র ও সম্ভাবনা দেখে যে তারা পুরো নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই তারা ভেবেছে, এটা না করাই ভালো...
মেহদি হাসান: কিন্তু আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বাংলাদেশে তাদের লাখ লাখ সমর্থক আছে।
অধ্যাপক ইউনূস: আমি লাখ লাখ বলব না। তাদের সমর্থক আছে। কিন্তু কতজন অবশিষ্ট আছে, তা আমি জানি না। কারণ, সমর্থক এমন একটি বিষয় যে আপনি খুব ক্ষমতাধর, আমি সবসময় আপনার সামনে মাথা নত করি, কারণ আপনি ক্ষমতাধর। আমি একজন সমর্থক হয়ে তা করছি না।
মেহদি হাসান: কিন্তু আপনি এটা অস্বীকার করতে পারেন না যে, বাংলাদেশে তাদের ভোটার আছে।
অধ্যাপক ইউনূস: অবশ্যই, এটা দীর্ঘ দিনের একটি দল।
মেহদি হাসান: কিন্তু এখন সেই ব্যক্তিদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। আপনি তাদের দলকে নিষিদ্ধ করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি তাদের দলকে রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধা দিয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূস: তারা ভোটার হিসেবে ভোট দিতে পারে। তারা বৈধ ভোটার। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। তারা নিজেদেরটা বেছে নেবে। আওয়ামী লীগের মার্কাটা সেখানে থাকবে না।
মেহদি হাসান: মানুষ বলছে, নতুন সরকার আগের সরকারের মতো আচরণ করছে। এ পরিস্থিতি কি বাংলাদেশের জন্য ভালো?
অধ্যাপক ইউনূস: এটি ছাড়া আমরা নির্বাচন করতে পারব না। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছে না। তারা যে মানুষ হত্যা করেছে, এখনো সে অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। তারা ক্ষমতায় থাকাকালে যা করেছে, তার কোনো দায়িত্ব এখনো নেয়নি। সবসময়ে তাদের কার্যক্রমের জন্য অন্যকে দায়ী করে আসছে।
মেহদি হাসান: গত নভেম্বরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩০ হাজার মানুষ আপনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তাদের সম্প্রদায়ের ওপর হাজারো হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও সে সময়ে বাংলাদেশে এসব হামলাকে বর্বর বলে উল্লেখ করেছেন। এসব বড় বা ছোট হামলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কী লাগবে? এসব কি নিয়ন্ত্রণ হয়েছে?
অধ্যাপক ইউনূস: প্রথমত, এগুলো মিথ্যা সংবাদ।
মেহদি হাসান: আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্ধৃতি করে বলেছি, আর আপনি বলছেন যে এগুলো মিথ্যা সংবাদ?
ড. ইউনূস: হ্যাঁ, ডোনাল্ড ট্রাম্প কি কখনো এ রকম কথা বলেছেন? বাংলাদেশে এখন কী হচ্ছে, সে বিষয়ে কি তিনি জানেন?
মেহদি হাসান: আপনি বলছেন, অভিযোগগুলো শুধু অতিরঞ্জিত নয়, মিথ্যা। বাংলাদেশে কি কোনো সহিংসতা হয়নি? নিউইয়র্ক টাইমস একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেগুলো কি আপনি অস্বীকার করবেন?
অধ্যাপক ইউনূস: ভারতের এখন একটি বিশেষত্ব হচ্ছে মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো। ভুয়া খবরের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।
মেহদি হাসান: আমি সেটি বুঝি, সেগুলো অতিরঞ্জিত। কিন্তু আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশে কোনো হিন্দুর ওপর সহিংসতা হয়নি?
অধ্যাপক ইউনূস: বাংলাদেশে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজমান। পারিবারিক সমস্যা, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। এখন আপনি এটিকে তো হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বলতে পারেন না।
মেহদি হাসান: আপনি বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর এ সংঘাতের সংখ্যা বাড়েনি? স্বাধীন সাংবাদিকরা বলছেন, বেড়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস: না, এ সংখ্যা বাড়েনি। সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে। কারণ, ভারত এটিকে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।