জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী এই সফরে তিনি শুধু বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বই করেননি, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ পথচলাকে নতুন উচ্চতায় তুলে ধরেছেন।
ড. ইউনূসের এই সফরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণ, বিভিন্ন বৈশ্বিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা তুলে ধরা এবং নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্জন স্থান পায়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সফরের উল্লেখযোগ্য ছয় সাফল্যের কথা তুলে ধরেন।
স্ট্যাটাসে তিনি যে ছয় সাফল্যের কথা তুলে ধরেন তা নিম্নরূপ-
১. গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির বার্তা
সাধারণ পরিষদের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। জনগণ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে এই আশ্বাস ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অঙ্গীকার।
প্রধান উপদেষ্টার সফরে বাংলাদেশের ছয়টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এটিই প্রথমবার যখন বিভিন্ন দলের এমন এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল একসঙ্গে বিদেশ সফরে গেলেন। তারা কূটনীতিক, প্রবাসী নেতৃবৃন্দ এবং ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। এ উদ্যোগ বিশ্বকে বার্তা দিয়েছে যে- বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগোচ্ছে।
২. বৈশ্বিক নেতাদের সঙ্গে কৌশলগত সংলাপ
সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস একাধিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন, যেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, বাণিজ্য, জলবায়ু সহনশীলতা ও মানব উন্নয়ন ইস্যুতে আলোচনা হয়। তিনি ইতালি, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, আলবেনিয়া, কসোভো ও ভুটানের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্দি, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমা, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা এবং আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠক করেন।
ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আয়োজিত এক নৈশভোজেও যোগ দেন, যেখানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বেশকিছু নেতার সঙ্গে আলাপ হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূতের সঙ্গেও তার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়, যা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকার গুরুত্বকে তুলে ধরে।
৩. রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক নেতৃত্ব
প্রধান উপদেষ্টার সফরের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল রোহিঙ্গা সংকট। তিনি এক মিলিয়নেরও বেশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভূমিকা তুলে ধরেন।
জাতিসংঘ ও দাতা দেশগুলোর সঙ্গে বৈঠকে তিনি মিয়ানমারে নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য নতুন করে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা আদায় করতে সক্ষম হন তিনি।
৪. এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতিতে জাতিসংঘের স্বাধীন মূল্যায়ন আমন্ত্রণ
বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ও অগ্রগতির স্বচ্ছতা প্রদর্শনে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতিসংঘকে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি বিষয়ে স্বাধীন মূল্যায়ন করার আমন্ত্রণ জানান। এ আমন্ত্রণ বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসী অর্থনৈতিক যাত্রাপথ ও গঠনমূলক আন্তর্জাতিক মূল্যায়নের প্রতি উন্মুক্ততার প্রতীক।
৫. নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ
সফরে বিদেশে কর্মসংস্থান ও শ্রম অভিবাসনের নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে যায়। কসোভো, আলবেনিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠকে সেখানে বাংলাদেশি শ্রমশক্তির চাহিদা নিয়ে আলোচনা হয়। এ উদ্যোগ ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন অংশীদার দেশের সঙ্গে জনসম্পর্ক মজবুত করবে।
৬. সহযোগিতামূলক ভবিষ্যতের ভিশন
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অবস্থানকে আরেকবার পরিষ্কার করে দিয়েছে- বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক অংশীদার, যা গণতান্ত্রিক শাসন, মানবিক সংহতি ও গঠনমূলক আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন