মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ০২:৪৩ পিএম

ওয়াহাবি–সালাফি নিয়ে হঠাৎ কেন আলোচনা?

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ০২:৪৩ পিএম

ধর্মীয় সংস্কৃতি উৎযাপন। ছবি- সংগৃহীত

ধর্মীয় সংস্কৃতি উৎযাপন। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুফি ও বাউল সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা এবং ধর্মীয় বক্তৃতায় ওয়াহাবি–সালাফি প্রসঙ্গ ঘন ঘন ওঠায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এসব হামলায় কারা জড়িত সে বিষয়ে কখনোই স্পষ্ট অবস্থান দেওয়া হয়নি, তবুও জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- ওয়াহাবি কারা, সালাফি কারা, এবং তাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে পার্থক্য কোথায়? গবেষকরা বলছেন, এই বিতর্কের মূল শিকড় ইতিহাস, মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জটিল সম্পর্কের ভেতরে লুকিয়ে আছে।

ওয়াহাবি ও সালাফির কারা

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামি চর্চায় চারটি ধারা স্পষ্টভাবে বিদ্যমান—দেওবন্দি, সুফি, সালাফি ও ওয়াহাবি। তবে অধিকাংশ মুসলিমই হানাফি মাজহাব অনুসরণ করেন।

গবেষকদের মতে, ওয়াহাবিবাদের জন্ম ১৮শ শতকে সৌদি আরবের নজদ অঞ্চলে শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাবের হাতে।

অন্যদিকে, সালাফিবাদ এসেছে ১৯শ শতকের মিশরের দার্শনিক মুহাম্মদ আব্দুহ, জামালউদ্দিন আফগানি ও রাশিদ রিদার বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সালাফিরা ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মকে আদর্শ হিসেবে মানেন, আর ওয়াহাবিরা দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে শুদ্ধতার পাশাপাশি মাজার বা ওলি-আউলিয়ার ভক্তিকে ইসলামবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এই অঞ্চলের সুফিকেন্দ্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের মতাদর্শগত সংঘাত প্রকট হয়ে ওঠে।

সুফি ঐতিহ্য বনাম শুদ্ধতাবাদ

চট্টগ্রাম ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুফি-গবেষক কাজী মোহাম্মদ সাইফুল আসপিয়া মনে করেন, ইসলাম এ অঞ্চলে এসেছে সুফিদের হাত ধরে। তাদের দাওয়াত ছিল মানবিক, সহনশীল এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সমন্বয় ঘটানো। এর বিপরীতে ওয়াহাবি–সালাফি মতাদর্শ বহু সাংস্কৃতিক উপাদানকে ‘বিদআত’ বা ‘বিপথগামীতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

গবেষকরা মনে করেন, এই সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা থেকে মতাদর্শিক বিরোধের সূচনা হয়েছে। তবে তারা এটাও বলেন, ওয়াহাবি বা সালাফি হওয়া নিজে কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো যখন মতাদর্শকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে বিভাজন ও সহিংসতা উস্কে দেওয়া হয়।

সৌদি আরবের ভূমিকায় ওয়াহাবি

ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তারে সৌদি আরবের আর্থিক সহায়তার প্রশ্ন বহুদিনের। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে জানান, শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত প্রভাব মোকাবিলায় মিত্রদেশগুলোর অনুরোধে সৌদি আরব বিভিন্ন মুসলিম দেশে মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থায়ন করে। পরে এই কার্যক্রম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

গবেষকদের মতে, এভাবেই ওয়াহাবি-প্রভাবিত দাওয়াতি কর্মকাণ্ড বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি শাসনব্যবস্থা নিজেই নরমপন্থার দিকে অগ্রসর হয়েছে।

বাংলাদেশে পুনরুত্থান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাফী মো. মোস্তফা বলেন, বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি সৌদি আরবে কাজ করেন। তারা দেশে ফিরে নিজেদের দেখা ধর্মচর্চা প্রচারের চেষ্টা করেন। সমস্যা তখনই তৈরি হয়, যখন এই ব্যাখ্যার সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সুফিকেন্দ্রিক ও মাজারভিত্তিক ধর্মীয় সংস্কৃতির সংঘর্ষ হয়। ফলে মাজারকে শিরক বলা, বাউল-সুফি সংগীতকে হারাম আখ্যা দেওয়া বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমালোচনা- এসব থেকে সামাজিক উত্তেজনা তৈরি হয়। গবেষকরা মনে করেন, এই সাংস্কৃতিক সংঘাত ওয়াহাবি–সালাফি বিতর্ককে আরও তীব্র করেছে।

ওয়াহাবিবাদের দর্শনগত সমালোচনা

ধর্মতাত্ত্বিকরা ওয়াহাবি মতাদর্শের মূল সমস্যাগুলোর একটি হিসেবে দেখান তাকফির- অর্থাৎ যে মুসলমান তাদের মতো না, তাকে কাফের ঘোষণা করা।

ইতিহাস বলছে, শায়খ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব প্রথমে নিজের হাম্বলি মাশায়েখদেরই কাফের ঘোষণা দেন। তার বড় ভাই ইমাম সুলায়মান বিন আব্দুল ওয়াহহাব একটি বিস্তৃত বই লিখে দেখান যে, ওয়াহাবিবাদ মূলধারার হাম্বলি আকিদার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া ওয়াহাবিরা ইবনে তায়মিয়্যাহর দার্শনিক ও জটিল ধর্মতত্ত্বকে আংশিকভাবে উদ্ধৃত এবং ভুলভাবে প্রয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

গবেষকদের মতে, ধর্মতত্ত্বের এই সরলীকরণই পরবর্তীতে সহিংস ব্যাখ্যার জন্ম দেয়।

ওয়াহাবি মতাদর্শ তাওহিদকে তিন ভাগে ভাগ করেছে—রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত ও আসমা-ও-সিফাত। সুন্নি ইসলামের মূলধারার তুলনায় এই বিভাজন অনেকটাই নতুন ব্যাখ্যা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাকফির, এর মাধ্যমে অন্য মতের মুসলমানদের ‘সত্য পথ থেকে বিচ্যুত’ ঘোষণা করা হয়।

ইতিহাসবিদরা বলেন, এই ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রথম দিকের বহু গণহত্যা ও দখল অভিযান পরিচালিত হয়।

সালাফিবাদের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি

আধুনিক সালাফি আন্দোলন মোট তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। প্রথম শাখা হলো ‘বিশুদ্ধ নাজদি’-যারা শায়খ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাবের কঠোর ব্যাখ্যা অনুসরণ করে এবং সৌদি রাজপরিবারের সমালোচনায় সরব।

দ্বিতীয় শাখা ‘মাদখালি’—যারা সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যে বিশ্বাসী এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত রক্ষণশীল।

তৃতীয় শাখা হলো মধ্যমপন্থী বা দ্বৈতপ্রবণ সালাফি- তত্ত্বে কঠোর হলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে নমনীয়।

গবেষকরা বলেন, এই দ্বিচারিতার কারণেই বহু তরুণ প্রথম শাখার দিকে ঝুঁকে চরমপন্থী গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়।

বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক প্রভাব ও উত্তেজনা

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে সুফি-ভিত্তিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের দেশ। মাজার, বাউল, লালনচর্চা, আউলিয়া-ভক্তি- এসব শুধু ধর্মের অংশ নয়, বরং সংস্কৃতিরও মূল অনুষঙ্গ। ফলে ওয়াহাবি–সালাফি মতাদর্শ যখন ‘শুদ্ধতা’র নামে এসবকে অচল বা হারাম ঘোষণা করে, তখন সাংস্কৃতিক বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর কয়েকটি হামলার ঘটনার সঙ্গে ওয়াহাবি–সালাফি মতাদর্শের কিছু মানুষের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও তদন্তে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো প্রকাশ পায়নি।

Link copied!