গত বছর বাংলাদেশে জেন-জিদের হাত ধরে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বিশ্বমহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেই রেশ এখন গোটা বিশ্বেই তরঙ্গ তুলছে।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় শুরু হয়েছে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানী জাকার্তাসহ বিভিন্ন শহরে সেনা মোতায়েন করেছে সরকার। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলা চালিয়েছে, এমনকি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বাড়িও আক্রমণের শিকার হয়েছে।
অন্যদিকে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) নেপালে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে তরুণ প্রজন্ম। পুলিশ গুলি চালালে অন্তত ১৯ জন নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়। কাঠমান্ডুর বীর হাসপাতাল ও সিভিল হাসপাতালে নিহতদের লাশ নেওয়া হয়েছে, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
জেন-জি কারা?
প্রতিটি প্রজন্মই গড়ে ওঠে ভিন্ন সামাজিক ও প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপটে। কেউ রেডিও শুনে বড় হয়েছে, কেউ টিভি আর ভিসিআরের যুগে, কেউবা প্রথম মোবাইল ফোনে এসএমএস লিখেছে। আর আজকের প্রজন্ম—যারা জন্মের পর থেকেই হাতে পেয়েছে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট—তারা হলো জেনারেশন জেড বা জেন-জি।
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া এই প্রজন্মের বয়স এখন ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের বলেন ডিজিটাল নেটিভস, কারণ শৈশব থেকেই তারা ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত।
তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অভিযোজন ক্ষমতা ও নতুন ভাবনায় বিশ্বাস। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, গেমিং—সবই এদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইন টিউটোরিয়াল থেকে শেখা, নিজস্ব কনটেন্ট তৈরি, ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা এই প্রজন্মকে আলাদা করেছে।
তবে সমালোচনাও আছে। দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে কাটানোর কারণে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমছে, আর তথ্যের অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে মানসিক অস্থিরতা ও একাকীত্ব। একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া আত্মপ্রকাশ সহজ করলেও আত্মসম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্যে চাপ ফেলছে।
বাংলার গণঅভ্যুত্থানে জেন-জি
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই শুরু হয় যে তরঙ্গ, তা রূপ নেয় ‘৩৬ জুলাই আন্দোলনে’। ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তিন সপ্তাহের মধ্যেই দেড় দশকের স্বৈরশাসনকে পতনের মুখে ঠেলে দেয়।
আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফারহান, দীপ্তদের মতো তরুণরা শুধু ব্যক্তিগত সাহস নয়, বরং সমষ্টিগত চেতনার শক্তি দেখিয়েছেন। তাদের প্রাণশক্তি প্রমাণ করেছে—এই প্রজন্ম গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য রাস্তায় নামতে দ্বিধা করে না।
মার্কিন কংগ্রেসম্যান ড্যারেন সোটো একে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জেন-জি বিপ্লব শেখ হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটিয়েছে।’
ইন্দোনেশিয়া কেন উত্তপ্ত
সংসদ সদস্যদের জন্য মাসিক ৫০ মিলিয়ন রুপি (প্রায় ৩ হাজার মার্কিন ডলার) আবাসন ভাতা অনুমোদনের খবর প্রকাশিত হতেই ইন্দোনেশিয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এটি দেশের ন্যূনতম মজুরির ১০ থেকে ২০ গুণ, যা ধনী রাজনীতিবিদ ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের ব্যবধানকে প্রকট করেছে।
পরিস্থিতি বিস্ফোরণমুখর হয় ২১ বছরের ফুড ডেলিভারি কর্মী আফফান কুরনিয়াওয়ানের মৃত্যুর ঘটনায়। পুলিশের গাড়ির চাপায় নিহত আফফান কোনো বিক্ষোভে অংশ নেননি, কেবল খাবার পৌঁছে দিতে বেরিয়েছিলেন। তিনি হয়ে ওঠেন বৈষম্যের শিকার সাধারণ মানুষের প্রতীক।
এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ছাত্র সংগঠনগুলো সামনের সারিতে আসে, আফফানের মৃত্যু আন্দোলনকে গণবিস্ফোরণে রূপ দেয়। দুর্নীতি, বৈষম্য ও ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে তরুণেরা রাস্তায় নেমে আসে—যেমনটা হয়েছিল বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর।
জেন-জি’র হাতে নেপাল সরকারের পতন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের নেতৃত্বে একের পর এক গণবিস্ফোরণ প্রমাণ করছে, ক্ষমতার আসনে বসে থাকা সরকারগুলোর জন্য সতর্কবার্তা এখন তরুণদের হাতেই। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর এবার প্রতিবেশী নেপালও সাক্ষী হলো এক ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিবর্তনের, যেখানে কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রযুক্তিবান, সোচ্চার ও ক্ষুব্ধ একটি প্রজন্ম ‘জেনারেশন জেড’।
নেপালে টানা দুই দিনের সহিংস, প্রাণঘাতী দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি।
কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়, রাজধানী কাঠমান্ডু ও আশপাশের জেলায় ছড়িয়ে পড়া এই ‘জেন-জি আন্দোলন’-এ এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের মূল দাবি ছিল দুর্নীতির অবসান, রাজনৈতিক সংস্কার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার।
গতকাল সোমবার আন্দোলনের প্রথম দিনেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১৯ জন। জারি করা হয় কারফিউ, বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট। তবে আজ মঙ্গলবার তরুণেরা কারফিউ অমান্য করে রাস্তায় নামে, বিভিন্ন মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বাসভবনে হামলা চালায়, এমনকি পার্লামেন্ট ভবনেও আগুন ধরিয়ে দেয়। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী প্রত্যুষ সুব্বা গুরুং থেকে শুরু করে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বিশ্ব পাউডেল- কেউই রেহাই পাননি বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ থেকে।
এদিকে, বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানেও ছিল একইরকম তরুণ-নেতৃত্বাধীন বিস্ফোরণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নির্বাচনি অনিয়ম ও প্রশাসনিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হয় তরুণ সমাজ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর রাজপথে শিক্ষার্থী, কর্মজীবী এবং নাগরিক সমাজের মানুষ গর্জে ওঠে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ দাবিতে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বহু তরুণ; মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি- সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাস্তায় নামার দৃঢ়তা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন