বাংলাদেশে ডেকোরেটিভ কাজে ব্যবহৃত রঙে ১,৯০,০০০ পিপিএম পর্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া ডেকোরেটিভ রঙে সীসার এই উদ্বেগজনক মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী রঙে সীসার সর্বোচ্চ ব্যবহার সীমা ৯০ পিপিএম। তবে গবেষণায় পরীক্ষিত প্রায় ৪২% নমুনায় এই সীমার বহুগুণ বেশি সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। লেড এক্সপোজার এলিমিনেশন প্রজেক্ট (LEEP), ইন্সটিগ্লিও, বিএসটিআই এবং ইউনিসেফ-এর সহযোগিতায় পরিচালিত ‘রঙে সিসার উপস্থিতি এবং সিসামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অগ্রগতি মূল্যায়ন’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্যসমূহ জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) এসডো প্রধান কার্যালয়ে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এই প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়।
গবেষণায় পরীক্ষিত মোট ১৬১টি নমুনার মধ্যে ৯৩টি (৫৭.৮%) নমুনায় নিরাপদ মাত্রা (৯০ পিপিএম-এর কম) পাওয়া গেছে। এই নমুনাগুলো প্রধানত ন্যাশনাল ও মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডের, যেমন: বার্জার, এশিয়ান পেইন্টস, নিপ্পন ইত্যাদি। অন্যদিকে ৪২.২% (১৬১টির মধ্যে ৬৮টি) নমুনা বিএসটিআই নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রা ৯০ পিপিএম-এর অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ২৬.২% নমুনায় ১,০০০ পিপিএম-এর বেশি এবং ৩.১% নমুনায় ৫০,০০০ পিপিএম-এর বেশি সিসা পাওয়া গেছে। এই উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত রং সাধারণত ক্ষুদ্র, স্থানীয় বা অনিবন্ধিত উৎপাদকের।
প্রেস ব্রিফিংয়ে এসডো’র চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সকল প্রকার রং থেকে সিসা নির্মূল করার জন্য কর্তৃপক্ষ ও শিল্প খাতের স্টেকহোল্ডারদের কাছে অবিলম্বে পদক্ষেপ দাবি করছি। উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহারে সম্মিলিত দায়বদ্ধতার পক্ষে আমরা কথা বলছি।’
এসডো’র সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘এই গবেষণাটি মনে করিয়ে দেয় যে কেবল আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য কাউকে দোষারোপ নয়, বরং সম্মিলিতভাবে সংকট মোকাবিলা করা, যেখানে শিল্পকলা, উৎপাদন এবং দৈনন্দিন জীবনে নিরাপত্তা অপরিহার্য।’
এসডো’র নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘আমরা যে রং ব্যবহার করি তা যদি নিরাপদ না হয়, তবে এটি প্রতিটি পরিবার ও শিল্পীর জন্য জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। সীসামুক্ত ভবিষ্যৎ অর্জনে আমরা সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে মিলিতভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন বলেন, ‘সম্পূর্ণভাবে সিসা নির্মূলই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা এবং বাজার থেকে লেড ক্রোমেট পাউডার বিলুপ্ত করার কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি।’
এসডো’র সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার প্রফেসর ড. আবুল হাশেম বলেন, ‘শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ সিসা দ্বারা ব্যাহত হয়। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে ৯০ পিপিএম সীমা পুনর্বিবেচনা ও বাস্তবায়ন তদারকি করতে হবে।’
বিএসটিআই-এর পরিচালক (কেমিক্যাল উইং) খোদেজা খাতুন বলেন, ‘যেসব ব্র্যান্ড সীসার মানদণ্ড মানছে না, তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা রয়েছে। আমরা সেগুলো সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
বিএসটিআই-এর সহকারী পরিচালক (কেমিক্যাল স্ট্যান্ডার্ডস উইং) মো. মঞ্জুরুল করিম বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে বিধিমালা এড়ানোর চেষ্টা করে। আমাদের উপায় বের করতে হবে যাতে তারা নিয়ন্ত্রণে আসে। পাশাপাশি শিল্প রঙের জন্যও নিয়মনীতি তৈরি করা জরুরি।’
বার্জার পেইন্টসের প্রতিনিধি মাসুদ রানা বলেন, ‘উৎপাদনে সীসা হয়তো সস্তা, কিন্তু এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। আমরা নিরাপদ জৈব রঞ্জক ব্যবহারের পরামর্শ দিই।’
গবেষণার প্রধান ফলাফল:
-
ক্যাঙ্গারু ব্র্যান্ডে (১,৯০,০০০ পিপিএম) সর্বোচ্চ সিসা রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর ইউরো (১,৭০,০০০ পিপিএম)। ক্যাঙ্গারু নমুনা আমদানিকৃত, বাংলাদেশে তৈরি নয়।
-
অন্যান্য উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত নমুনার মধ্যে রয়েছে নাহার (৮১,০০০ পিপিএম), নিউ টুয়া (৭৪,০০০ পিপিএম), টপ সিল (৫৪,০০০ পিপিএম), মদিনা বেটার রুবিল্যাক (১৯,০০০ পিপিএম), মেঘনা প্লাস (১৮,০০০ পিপিএম), র্যামি (১৮,০০০ পিপিএম) এবং তুর্কি (১৬,০০০ পিপিএম)। এই রংগুলো হলুদ বা সোনালি-হলুদ, অয়েল/সল্ভেন্ট-ভিত্তিক ডেকোরেটিভ রং।
-
হলুদ রঙে সর্বোচ্চ সিসা, লাল ও সাদা রঙেও উচ্চ মাত্রা।
-
কিছু রং শিল্পকারখানার ব্যবহারের জন্য বাজারজাত হলেও ডেকোরেটিভ রং হিসেবে বিক্রি হয়।
-
মাত্র ২১.৬% রঙে ‘সীসামুক্ত’ বা ‘পরিবেশবান্ধব’ লেবেল ছিল।
-
জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকেরও বেশি দোকানদার বিএসটিআই-এর সীসার নির্ধারিত মাত্রা সম্পর্কে জানতেন না।
-
১০,০০০ পিপিএম-এর বেশি সিসাযুক্ত সব নমুনা ক্ষুদ্র বা অনানুষ্ঠানিক উৎপাদক থেকে এসেছে।
-
চীন, সিঙ্গাপুর ও কিছু আমদানি করা নমুনাতেও অসঙ্গতিপূর্ণ সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
নমুনাগুলো বিশ্লেষণে NIOSH মেথড ৭৩০৩ অনুসরণ করে Inductively Coupled Plasma–Optical Emission Spectroscopy (ICP-OES) ব্যবহার করা হয়েছে। বাজারে রঙের ৯০ পিপিএম মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য পরীক্ষা করা হয়েছে। পাশাপাশি বাজার জরিপ ও পেইন্ট শিল্প সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে লেবেলিং, সচেতনতা ও বাজার অনুশীলন মূল্যায়ন করা হয়েছে।
নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত Wisconsin Occupational Health ল্যাবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন