রহস্যঘেরা এক ধনকুবের—নাম আজিজ মোহাম্মদ ভাই। বিলাসী জীবনযাপনেও বেশ আলোচিত তিনি। নানা কর্মকাণ্ডের কারণে সবসময় আলোচনায় থাকতেন তিনি। বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগতের নারী ও হত্যাকেন্দ্রিক ঘটনায় বেশ চর্চিত তিনি। এসব গল্পের কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা সে নিয়েও আছে নানা মত। তবে তাকে ঘিরে জল্পনার শেষ নেই।
ব্যবসায়ী পরিচয় ছাপিয়ে তিনি আলোচনায় আসেন চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে। নব্বই দশকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এমবি ফিল্মসের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসেন। চলচ্চিত্রপাড়ায় শোনা যায়, সে সময় পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মিডিয়া মালিকরা তাকে সমীহ করে চলতেন। তিনি ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন। দেশের বিজ্ঞাপন জগতে গ্লামার আনতেও তার ভূমিকা ছিল। নিজের প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ব্যাটারির ‘আলো আলো বেশি আলো’ বিজ্ঞাপনে মিতা নূরের ঝলমলে উপস্থিতি তখন বেশ নজর কেড়েছিল।
এরশাদের আমলে একবার আজিজ মোহাম্মদ ভাই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। প্রচলিত আছে, এক নারী নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেই এরশাদ তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। নব্বই দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনের যাবজ্জীবন আদেশ দেওয়া হয় গত বছরের মে মাসে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন অকাল প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলায় নাম জড়িয়ে। দীর্ঘ ২৯ বছর পর অভিনেতা সালমান শাহর অপমৃত্যু মামলা রূপ নিয়েছে হত্যা মামলায়। সালমান শাহ হত্যা মামলায় সর্বমোট ১১ জনকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যা মামলায় প্রধান আসামি নায়কের সাবেক স্ত্রী সামিরা হক। অন্য ১০ আসামির মধ্যে প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইও রয়েছেন।
চলচ্চিত্রপাড়ায় চর্চা রয়েছে, সালমান শাহ মারা যাওয়ার আগে একটি পার্টিতে তার স্ত্রী সামিরাকে চুমু দেন আজিজ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সকলের সামনে আজিজকে চড় মারেন সালমান শাহ। এটাকে মোটিভ হিসেবে ধরেন অনেকেই। সে সময় সালমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুইবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় আজিজকে। কিন্তু পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর ঢাকা ক্লাবে খুন করা হয় আরেক চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে। এ হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সে সময় সোহেল চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঢাকার ডিস ব্যবসা। এই ব্যবসা নিজেদের কব্জায় নিতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয় বলে ধারণা।
১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএসইসি। শেয়ার কেলেঙ্কারির ওই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে জামিন পেলে আর দেশে থাকেননি তিনি। এরপর কখনো দেশে ফিরে আসেননি। তথ্য আছে, আজিজ মোহাম্মদ পরিবার নিয়ে থাইল্যান্ডে থাকেন। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুরে আজিজ মোহাম্মদের হোটেল ও রিসোর্ট আছে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিপুল পরিমাণ মদের বোতল, সিসা ও ক্যাসিনো সামগ্রী উদ্ধার করে। ২০২১ সালের আগস্টে এনবিআর তার যাবতীয় ব্যাংক হিসাব জব্দ করে।
যেভাবে হলেন ‘ভাই’: আজিজ মোহাম্মদের নামের সঙ্গে ‘ভাই’ শব্দটি থাকার কারণে অনেকেই মনে করেন গডফাদার বলেই তাকে ভাই বলা হয়। সাধারণত মাফিয়া ডন বা গডফাদারদেরকে ভাই ডাকে তাদের অনুগতরা। কিন্তু আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নামে ‘ভাই’ শব্দটি মূলত তাদের বংশ পদবি। তাদের পরিবারের সকলেরই নামের শেষে ভাই পদবি আছে। এমনকি নারীদের নামের সঙ্গেও ভাই রয়েছে। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ভাই, মায়ের নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই।
১৯৪৭-এ ভারত ভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে আসে। তাদের পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভুত। তারা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। বাহাইয়ান’-কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’ বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়।
সালমান শাহ মামলার দ্বিতীয় আসামি রহস্যঘেরা আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘ সময় ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পরিবার নিয়ে অনেক বছর ধরে তিনি থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন বলে আলোচনা রয়েছে। থাইল্যান্ডের সৈকতে দেশের মতোই আমোদ-ফুর্তিতে মগ্ন রয়েছেন বলে সূত্রের খবর। চলচ্চিত্র নায়িকাসহ বিভিন্ন নারীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের সম্পর্ক নিয়ে নানা গল্প রয়েছে। নানা ঘটন-অঘটনে বরাবরই তিনি ছিলেন আলোচনায়। তবে বারবারই রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।



সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন