ঢাকা শনিবার, ০৮ নভেম্বর, ২০২৫

নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৫, ০৮:১২ পিএম
নির্বাচনে নিয়োজিত থাকবে ১ লাখ সেনা, দেড় লাখ পুলিশ। ছবি- সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে সব রকমের জট খুলে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস এবং সরকারের দায়িত্বশীলরা প্রতিনিয়তই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছেন।

নির্বাচনের আগে না নির্বাচনের দিন গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারিসহ বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসা এখনও না হলেও দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে মাঠ গরম করছে। পারছে না একমত হতে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, লুণ্ঠিত সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের চ্যালেঞ্জও মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারকে। যদিও সব উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে ফুল স্পিডেই এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনী ট্রেন। 

অন্তর্বর্তী সরকার যেনতেন একটি নির্বাচন করতে চায় না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর এক তরফা, রাতের ভোট ও আমি-ডামির মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চায় না দেশের মানুষও। বহু ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে এবার অবারিত সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে একটি প্রশ্নমুক্ত, অবাধ, সুুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের।

প্রধান উপদেষ্টা নিজেও এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। সপ্তাহখানেক আগে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন’র সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও সরকার প্রধান আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে তিন বাহিনীর প্রধানকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।

ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে সংসদ নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে থাকবে তিন বাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্য। তাদের মধ্যে ৯০ হাজার সেনাসদস্য, ২ হাজার ৫০০ জন নৌবাহিনীর সদস্য এবং এক হাজার ৫০০ জন বিমানবাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি উপজেলায় এক কোম্পানি সেনা মোতায়েন থাকবে। 

দেশের বিগত প্রায় প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের ঐতিহ্য রয়েছে। শেষের তিনটি বিতর্কিত ও অগ্রণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকলেও ছিল বেশ নিষ্ক্রিয়। এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অন্তহীন। কিন্তু তাঁরা কী নিজ ইচ্ছায় নিষ্ক্রিয় ছিলেন না কী আইনের মারপ্যাঁচ তাদের সক্রিয় হতে দেয়নি? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি ছিল।

অন্তর্বর্তী সরকার মূল সমস্যা জিইয়ে রেখে সমাধানের সূত্র খুঁজতে যায়নি। আগেভাগেই সমস্যা সনাক্ত করেছে। আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার অবশ্যই তাঁরা সাধুবাদ পেতে পারে। ‘যেমন ইচ্ছা তেমন নির্বাচন’ করার জন্যই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সরকার নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতাহীন করে দিয়েছিল। ‘

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু এবার শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার সব থেকে সেরা একটি জাতীয় নির্বাচন উপহার দিতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

নির্বাচন কমিশন (ইসি) আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে আর কারও নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে না। ফলত নির্বাচনী মাঠে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি যেকোন অপরাধী বা দুর্বৃত্ত গায়ে মাখতে বাধ্য।

নিজেদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী নি:সন্দেহে একটি উত্তম নির্বাচনের জন্য মোক্ষম দাওয়াই হতে পারে। দেশের সাধারণ মানুষও সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেম, নিরপেক্ষতা ও পেশাদার ভূমিকার উপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সশস্ত্র বাহিনী তার ভিত্তি লাভ করেছিল, সেই বাহিনী কোন গোষ্ঠীস্বার্থ নয় বরং ন্যায্যতার ভিত্তিতেই পক্ষপাতহীন ভূমিকার মাধ্যমে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখবে আজ ও আগামীর ইতিহাসের সোনালী পাতায়, দেশের সর্বস্তরের জনগণ এমনটাই বিশ্বাস করে।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে স্বত:স্ফূর্ত জাগরণের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বুকে গুলি না চালিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছিল সশস্ত্র বাহিনী। স্বাক্ষর রেখেছিল তাদের প্রকৃত দেশপ্রেমের উপমার। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হয়েছিল অভ্যুত্থানের। প্রতিটি দুর্যোগে-দুর্বিপাকেও সশস্ত্র বাহিনীর জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এমন উদাহরণের পাল্লা ভারী। 

সম্প্রতি সেনা সদর আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে-‘দেশের জনগণের মতো সেনাবাহিনীও চায় অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী একটা অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের রূপরেখার মধ্যে নির্বাচনের সময়সীমাও রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রত্যাশা করে, নির্বাচন হলে দেশের স্থিতিশীলতা আরও ভালো হবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে এবং সেনাবাহিনী তখন সেনানিবাসে ফিরে যেতে পারবে।’ জানানো হয়েছে- যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সেনাবাহিনী আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং ভ্রাতৃত্ববোধে দৃঢ়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য সেনাপ্রধান ও বাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ অনুগত এবং বিশ্বস্ত। 

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর সেনা ও ছাত্র-জনতার শক্ত সেতুবন্ধ বা রসায়নে সব ভেঙে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ। প্রত্যাশিত গণতন্ত্র, সৌভ্রাত্র, জাতীয় আত্মমর্যাদা, সাম্যের বোধ-চিন্তা হৃদয়-মস্তিষ্কে রেখেই জনতার সঙ্গে অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছে। এরপরেও ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা পেয়েও সেনাবাহিনী কেন বলপ্রয়োগ করেনি, কেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এখনও উন্নতির লক্ষণ নেই ইত্যাকার প্রশ্ন টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।

এ বিষয়ে আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমানের একটি উত্তর গভীর চিন্তার অর্থবহ মেরুকরণের মানদণ্ডে ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে সহজেই। সম্প্রতি সেনা সদরে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা না থাকলে অবনতি কতটা হতো আপনি তা ধারনাও করতে পারবেন না!

সেনাবাহিনী এই সময়ের মধ্যে কুমিল্লা-নোয়াখালীর বন্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দাবি-দাওয়া, বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে আনরেস্ট, বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনকে রক্ষা করা, ট্রাফিক দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই যে এই সীমিত জনবল দিয়ে করেনি। এখন ৪০ বা ৫০ হাজার সেনা সদস্য যাদের প্রাথমিক কাজ এটি নয় তাঁরা তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন।’ 

ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বুঝা বিবেকবান প্রতিটি মানুষই স্বীকার করবেন সরকার, সেনা ও জনতার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি ও সঙ্গশক্তির প্রয়াসের দৌলতেই পথ হারায়নি বাংলাদেশ। অন্ধকার টানেল থেকে আলোর পথে ফেরার অভিযাত্রায় একে অপরকে তাঁরা শামিল করেছেন ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে, অনির্বাণ আলোকবর্তিকা হয়েই। চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের মনে যখন অবৈধ অস্ত্র নিয়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ তখন আশাবাদী এক তথ্যই জানিয়েছে সেনা সদর দপ্তর।

সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস অধিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রের ৮১ শতাংশ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। গোলাবারুদ (হারিয়ে যাওয়া) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৭৩ শতাংশ। এছাড়া ১৯ হাজারের বেশি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

নির্বাচনের আগে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আয়ত্তে রেখে ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতির এই গ্রাফ সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবচেয়ে দুরূহ কাজে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে একে একে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে অকার্যকর হয়েছে সেখানে শুধুমাত্র পেশাদারিত্ব-প্রশিক্ষণ-গ্রহণযোগ্যতায় দেশপ্রেমী সশস্ত্র বাহিনী নিজেদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেছে।

গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদেরও একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে। মাঠে সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত পদক্ষেপের ফলেই আইনের শাসন এখনও আছে। নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকেই মবপাণ্ডাদের তেজ কমাতে বাধ্য করেছে। জনগণের মধ্যেও আইনের প্রতি হারানো শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হচ্ছে। শাসক নয় গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের মতো চব্বিশের ইতিহাসেও অত্যুজ্জ্বল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। 

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বারবার নির্বাচন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। ক্ষমতার মোহ নেই এটিও জানিয়ে দিয়েছেন বহুবার। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে যেন নির্বাচন হয়, সেই ভূমিকা রাখবেন। তিনি কথা রেখেছেন। যথারীতি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। সময়ও নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাফ জানিয়েছেন- ‘আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে যাওয়া।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি চাই, দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।’ একটি অর্থবহ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকারও। সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর সুদৃঢ় অঙ্গীকার নতুন সম্ভাবনার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর এই ঐক্যকে আরও সুসংহত করার কোন বিকল্প নেই।   


লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সন্ধানী বার্তা