তাজিকিস্তান গত অক্টোবরে আইনি (আয়নি) বিমানঘাঁটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছে, এর ফলে প্রায় দুই দশক ধরে চলা ভারতের অপারেশনাল উপস্থিতির ইতি ঘটেছে। মধ্য এশিয়ার এই সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যে গভীর পরিবর্তন এনেছে, বিশেষ করে যখন রাশিয়া ও চীন এখানে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আরও সুদৃঢ় করছে। নয়াদিল্লির জন্য এটি কেবল একটি সামরিক ঘাঁটির ক্ষতি নয়- এটি পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বৃহত্তর ইউরেশিয়ান অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত নাগালের উল্লেখযোগ্য সংকোচনের প্রতীক।
দুশানবে থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত আইনি বিমানঘাঁটি- যা ফারখোর-আইনি কমপ্লেক্স নামেও পরিচিত- এটি সোভিয়েত আমলে নির্মিত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আফগান অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল এটি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তাজিকিস্তান ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ পায়, কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের গৃহযুদ্ধ ও আর্থিক অক্ষমতার কারণে এটি কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
২০০২ সালে তাজিকিস্তানের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ভারত ঘাঁটিটি সংস্কার করে। প্রায় ৭০–১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে ভারত রানওয়ে ৩ হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত সম্প্রসারণ, নতুন হ্যাঙ্গার, রাডার ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণ করে।
এর ফলে সুখোই-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান ও এমআই-১৭ হেলিকপ্টার মোতায়েন সম্ভব হয়। আয়নি ছিল ভারতের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিদেশি ঘাঁটি- একটি কৌশলগত অগ্রবর্তী পোস্ট, যা আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডোর ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের ওপর নজরদারি সম্ভব করত।
ঘাঁটিটি দুশানবে থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এবং আফগানিস্তানের সীমান্ত থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর অবস্থান ভারতের জন্য ছিল অমূল্য- চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ত্রিমুখী সংযোগস্থলের কাছাকাছি হওয়ায় এটি গোয়েন্দা নজরদারি, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান এবং মানবিক সহায়তা সমন্বয়ের একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। ২০০১ সালে আহমদ শাহ মাসুদের হত্যাচেষ্টার পর তাকে ভারতের ফারখোর ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল- যা আইনির মানবিক ও কৌশলগত ভূমিকার প্রতীক হয়ে আছে।
২০২২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তাজিকিস্তান ইজারা নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত জানায়। কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, মস্কো ও বেইজিংয়ের তীব্র চাপের কারণেই দুশানবে ভারতকে লিজ নবায়নের অনুমতি দেয়নি।
রাশিয়ার দৃষ্টিতে, যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা (কোস্ট) কাঠামোর বাইরে একটি ভারতীয় ঘাঁটির উপস্থিতি তাদের আঞ্চলিক কমান্ড নীতির সঙ্গে অসঙ্গত ছিল।
অন্যদিকে, চীনের মতে, জিনজিয়াং সীমান্তের এত কাছে একটি ভারত-পরিচালিত ঘাঁটি একটি ‘নজরদারি ঝুঁকি’ তৈরি করেছিল। চীনা ঋণ নির্ভর অর্থনীতি ও রাশিয়ার নিরাপত্তা নির্ভরতায় জর্জরিত তাজিকিস্তান শেষ পর্যন্ত ভারতকে চুক্তি নবায়নের সুযোগ দেয়নি।
আয়নির ক্ষতি ভারতের জন্য একাধিক দিক থেকে কৌশলগত বিপর্যয়। মধ্য এশিয়ায় একমাত্র ঘাঁটি হারিয়ে ভারত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে গোয়েন্দা নজরদারির সক্ষমতা হারিয়েছে। ওয়াখান করিডোর ও শিনজিয়াং অঞ্চলে নজরদারির সুবিধাও আর থাকছে না। ফলে, রাশিয়া ও চীনের যৌথ প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের উপস্থিতি ও প্রভাব ওই অঞ্চলে দুর্বল হচ্ছে।
রাশিয়া তাজিকিস্তানে তার ২০১তম মোটর রাইফেল ডিভিশনের মাধ্যমে ৭ হাজার সৈন্য মোতায়েন রেখেছে- যা বিদেশে তাদের বৃহত্তম স্থায়ী মোতায়েন।
অন্যদিকে, চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর মাধ্যমে অবকাঠামো ও নিরাপত্তা প্রকল্পে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই দুই শক্তির প্রভাব বলয়ে দুশানবে ভারতের তুলনামূলক নরম কূটনীতি ধরে রাখতে পারেনি।
আয়নি ঘাঁটি হারানোর পর ভারত এখন মধ্য এশিয়ায় নতুন বিকল্প খুঁজছে। বিশ্লেষকদের মতে, কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে দ্বৈত-ব্যবহার চুক্তি ভারতের জন্য সম্ভাব্য পথ হতে পারে। চাবাহার বন্দর ও আইএনএসটিসি করিডোরকে কাজে লাগিয়ে ভারত বাণিজ্য ও সরবরাহনির্ভর কৌশলগত উপস্থিতি বজায় রাখতে চাইছে। একই সঙ্গে, উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টরে দীর্ঘপাল্লার ড্রোন মোতায়েন ও আকাশ নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনাও বিবেচনায় রয়েছে।
আয়নি ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে দুশানবে তার সার্বভৌমত্ব জোরদার করেছে- কিন্তু বাস্তবে মস্কো ও বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরতা আরও গভীর হয়েছে। দেশটির বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ চীনের কাছে, আর অর্থনীতির প্রায় ৩০ শতাংশ নির্ভর করে রাশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্সে। ফলে সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার ঘোষণার আড়ালে তাজিকিস্তান কার্যত দুই পরাশক্তির প্রভাব বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

