জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। একই সঙ্গে চূড়ান্ত এই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যেকোনো দুজন প্রতিনিধি স্বাক্ষর করবেন—তাদের নাম আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে কমিশন।
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সুপারিশ নিয়ে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
তিনি জানান, গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর চূড়ান্ত ভাষ্য পাঠানো হয়েছে। এ সনদে সকলের মতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. আলী রীয়াজ।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সুপারিশ নিয়ে দলগুলো এখনো একমত হতে পারেনি। তবে জুলাই সনদে সুপারিশগুলোর মধ্যে দুটি ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। সংবিধানসংশ্লিষ্ট নয় এসব বিষয়ে এই সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং সুপারিশে যেসব বিষয়ে সরকারের সংস্থাগুলোর বাস্তবায়নের এখতিয়ার আছে সেসব বিষয়ে সরকার আদেশের মাধ্যমে সংস্কার করতে পারবে বলে তারা ঐক্যে পৌঁছায়।
সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশ জারি ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে চূড়ান্ত জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায়ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামতের ভিত্তিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এর আগে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলা এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আলোচনায় শুরুতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া ৪ ধরনের প্রস্তাব/সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে কমিশন উপস্থাপন করে।
সুপারিশগুলো হলো: গণভোট, অধ্যাদেশ জারি, নির্বাহী আদেশ জারি এবং পরবর্তী সংসদের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ। এ সময় সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত তুলে ধরেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জামায়াত, তবে ভিন্নমত বিএনপির। আর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বিপজ্জনক হবে এমন আশঙ্কা বামজোটের নেতাদের।
ঐকমত্য কমিশন জানায়, দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫ পদ্ধতিতে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। এগুলো হলো: অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া।
তবে আরও বিস্তারিত আলোচনার পর সনদে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোকে (যার মধ্যে ভিন্নমত) ৪ উপায়ে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয় ঐকমত্য কমিশন। ফলে বাদ পড়ে সনদ বাস্তবায়নে ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার পদ্ধতি। বিশেষজ্ঞদের এসব প্রস্তাবের ব্যাপারে আলোচনায় আলাদা মতামত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
জুলাই সনদের সাংবিধানিক দিকগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সনদ বা এর কিছু অংশ নিয়ে গণভোট, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা বলে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠন করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পদক্ষেপ, ত্রয়োদশ সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভারূপে প্রতিষ্ঠা করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মতামত চাওয়া যে, যাতে বলা হবে অন্তর্বর্তী সরকার এ সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না।
বৈঠকের সূচনা বক্তব্য রাখেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। তিনি জানান, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সংস্কার ইস্যুগুলোর সাফল্য বা বাস্তবায়নের ওপর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ভর করছে। তবুও সনদ বাস্তবায়ন কিংবা রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে দলগুলোর ওপর কিছুই চাপিয়ে দিবে না কমিশন।
এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে জমা দেবে। এরপর সনদ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। কারণ রাষ্ট্র সংস্কারের ৮৪টি ইস্যু এবং দলগগুলোর জন্য ৭ দফা অঙ্গীকার নিয়ে তৈরি জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের ক্ষমতা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেই। ফলে এটি বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন।
গতকাল বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে মতামত তুলে ধরেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আলোচনায় বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি জানায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতা ও আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির এ দাবি জানান।
অন্যদিকে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতেই হতে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একই মত জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের নায়েবে আমির ইউসুফ আশরাফ। তার মতে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সনদ বাস্তবায়ন করবে কি না তা অনিশ্চিত।
অন্যদিকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন উদ্দিন আহমেদের মতে, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আপিল বিভাগের মত নিয়ে এই সরকার সংবিধান সংস্কার করলে ভবিষ্যতে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
সনদ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ হলে তা বিপজ্জনক হবে এমন আশঙ্কা জানান বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, এমনটি হলে ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি যেকোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতে পারেন। তার মতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে আগামী জাতীয় সংসদ। কারণ সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই সরকার চলছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, বিদ্যমান সংবিধানেই মৌলিক বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো। কমিশন যেসব প্রশ্নে এক হয়েছে, আগামী সংসদের প্রতিনিধিরা তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবেন, সে সংক্রান্ত আইন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আগামী সংসদ হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে; যারা দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ মাসে দেশের মৌলিক সংস্কারের কাজ করবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনাও করবে।
আগামী রবিবার দুপুর ২.৩০টায় আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসবে ঐকমত্য কমিশন। এর আগে জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করতে চলতি বছরের ২০ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দু’দফায় ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ৬৭টি বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন।
এসব আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে ১৪টি নোট অব ডিসেন্ট আসে। পরে সব প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয় জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া। এই খসড়ার ওপর মতামত আহ্বান করে গত ১৬ আগস্ট ৩০টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
উল্লেখ্য, জুলাই সনদ প্রণয়নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে। ৬ মাস মেয়াদ শেষে কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হবে এই কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ ।