বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোরনের সময় জুলাই-আগস্টে মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী ও আসাদগেট এলাকায় ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে সরাসরি নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের নেতা ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করেন। পতিত আ.লীগের দোসর পাগলা মিজান বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে মোহাম্মদপুর এলাকায় আ.লীগের হয়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন তিনি। নিজের বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে অস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়ান আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর। এতসব কাণ্ডে একাধিক মামলার আসামি হয়েও এখনো অধরা পাগলা মিজান।
ছাত্রহত্যা মামলার আসামি হয়েও মিজান বর্তমানে নিজেকে বিএনপির সমর্থক দাবি করে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোপনে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ করেছে তার এলাকার বাসিন্দারা। ৫ আগস্টের আগে-পরে একাধিক হত্যা মামলা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের এত ক্ষমতার উৎস ছিল আ.লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। আদাবর থানা যুবলীগের আহ্বায়ক আরিফুর রহমান তুহিন ছিল মিজানের মাই ম্যান। তুহিনের মাধ্যমেই আদাবর এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখতেন মিজান।
মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে সাবেক কাউন্সিলর রাজিব, আলা বক্সের ভাই ইয়াসিন বক্স, সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুদ রানা শাহীন, মজিবর প্রমুখ। যারা সবাই মোহাম্মদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা এবং পাগলা মিজানের সহকারী বলে সবার কাছে পরিচিত। ছাত্র আন্দোলনের সময় এদের সবাইকেই অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামায় মিজান।
এদের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের সময় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে চালাতে গত ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে শটগানে বুলেট আটকে যায় সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুদ রানা শাহীনের। সেদিন একটি পিস্তলও হারিয়ে ফেলেন শাহীন। তিনিও এই পাগলা মিজানের খাস লোক হিসেবে পরিচিত।
ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে অপরাধ জগতে পদার্পন, আওয়ামী লীগের ব্যানারে কাউন্সিলর হয়ে রাজনীতিতে আগমন। মাঝখানে চুরি, ছিনতাই, খুন-জখম, দখল, চাঁদাবাজি, মাদকের সিন্ডিকেট চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি-গাড়ি রয়েছে এক সময়ের হোটেলবয় হাবিবুর রহমান মিজানের। ঢাকা উত্তরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের (মোহাম্মদপুর) সাবেক কাউন্সিলর ও মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে বিপুল সম্পদ বানান মিজান। ক্যাসিনো কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মিজানের দৃশ্যমান কোনো রোজগার ছিল না।
মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধে বারবার উঠে এসেছে এই মিজানের নাম। কয়েকবার জেলে গেলেও অল্প সময়েই ফের বেরিয়ে এসে ‘হাল ধরেছেন’ নিজের অপরাধ সাম্রাজ্যের। বর্তমানে জেনেভা ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসার সিন্ডিকেট চালিয়ে মাসিক কোটি টাকা পান। মিজানের অপরাধের তালিকা করা কঠিন। খুন থেকে মাদক ব্যবসা, সবখানেই মিজানের হাত ছিল। বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকায় মিজান ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত।
মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও বারবার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে ছাড়া পেয়ে যেতেন। সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান শুধু মোহাম্মদপুরে নয় শ্যামলী-আদাবর এলাকাতেও তার ব্যাপক দাপট। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সদস্যদের ব্যবহার করে বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে যান এই পাগলা মিজান। পাগলা মিজান জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করত।
এদিকে চলতি বছরের ১১ জুলাই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদ হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের পরিবারের ১৬টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ রাখার আদেশ দেন। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর দুদক মামলাটি করে। মামলার পর পাগলা মিজান, তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ের নামে থাকা ১৬টি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেন আদালত। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, হাবিবুর রহমান অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে মোট ৩০ কোটি ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩১ টাকা ৩৪ পয়সার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
তার ভাইদের নামেও রয়েছে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারি টেন্ডার ছাড়াই বিভিন্ন দপ্তরের কাজ বাগিয়ে নিয়ে মিজান তার ভাইদের দিতেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৫ সালে দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে নিহত হন। বর্তমানে ঠিকাদার হেলাল, দুলাল ও শাজাহান নামে তার আরও তিনটি ভাই রয়েছে। মিজানের ভাই শাজাহান লালমাটিয়া ওয়াসার অফিস নিয়ন্ত্রণ করত। একই সঙ্গে আবাসিক গ্যাসলাইন নিয়ন্ত্রণ করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। মিজানের আরেক ভাই হেলাল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঢাকা-১৩ আসনের সদ্য সাবেক এমপির আমলে বিনা টেন্ডারে ৫ থেকে ৬শ কোটি টাকার এলজিআরডি ও সিটি করপোরেশনের কাজ করছে। যার ভাগ এলাকাটির আওয়ামী লীগের সব বড় নেতার পকেটে ঢুকত নিয়মিত।
হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান ১৯৯৪ সালে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৫ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর মিজান হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। বাড়ি দখল, জমি দখল, খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনেক অপরাধে যুক্ত হন। আ.লীগের ব্যানারে সক্রিয় রাজনীতির বদৌলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়ে যান মিজান। সঙ্গে পাল্টে দেন নিজের নামটিও, হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। পাগলা মিজান রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেন অপরাধের সাম্রাজ্য। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, টেন্ডারবাজির মাস্টার ছিলেন।
নিজের কোনো ব্যবসা নেই, তবুও দেশে-বিদেশে রয়েছে তার কোটি কেটি টাকার সম্পত্তি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মিজানের আলিশান দুটি বাড়ি ও দামি গাড়ি রয়েছে। দেশ থেকে অবৈধ আয়ের অর্থ পাচারের মাধ্যমে বিদেশে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন পাগলা মিজান। পাগলা মিজান মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। মোহাম্মদপুরে অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতা ছিলেন এই কাউন্সিলর। তার কারণে মোহাম্মদপুরে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ক্ষমতার জোরে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত। চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকাতেও তৎকালীন হাউজিং চেয়ারম্যান প্রয়াত আক্কাস হাজীর কাছ থেকে বেশকিছু প্লট বাগিয়ে নিয়েছিলেন এই মিজান।
লালমাটিয়া এলাকায় স্বপনপুরী হাউজিংয়ে রয়েছে তার আরও দুটি বহুতল বাড়ি। লালমাটিয়া বি-ব্লকে একটি ছয় তলা বাড়ি (২৪/এ)। এরই পাশে ২৪/এ এর সি/ডি নম্বরে লালমাটিয়ায় আরও একটি ৭ তলা ভবন রয়েছে তার। মোহাম্মাদপুরের আওরঙ্গজেব সড়কে আছে আরেকটি ফ্ল্যাট, যেখানে তিনি নিজে বসবাস করেন। এ ছাড়াও রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি পাঁচতলা ভবনের মালিক হাবিবুর রহমান মিজান। সেখানেও ১০টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। পাগলা মিজান মিশুক অ্যান্ড কোম্পানির মালিক। ঢাকার হজ কাফেলা অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের মালিক।
১৯৭৪ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসেন মিজানুর রহমান। শুরুতে মিরপুরে হোটেল বয়ের কাজ নেন। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকার ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি শুরু করেন। চুরি করা সেই ঢাকনাই আবার বিক্রি করতেন সিটি করপোরেশনে। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে। ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ ও তার স্ত্রী ময়িম বেগমকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করেন তিনি। এরআগে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিজান ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুর এলাকায় শুরু করেন চাঁদাবাজি, ছিনতাই। ছিনতাইকারী হিসেবেই ১৯৭৪/৭৫ সালে তার বিশেষ পরিচিতি আসে। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর খামারবাড়ি খেজুর বাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়া মসজিদের পাশের পুকুরে নেমে পড়েন মিজান। যাতে পুলিশ কাছে আসতে না পারে সেজন্য ৪-৫ ঘণ্টা পর তিনি কাপড় ছাড়াই উপরে উঠে আসেন। এমন আচরণে পুলিশ তাকে পাগল বলে ছেড়ে দেয়। তার এ ধরনের কাজের জন্য পুলিশ তাকে ‘পাগলা’ আখ্যা দেয়। তখন থেকেই এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ‘পাগলা’ মিজান নামে।
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেপ্তার র্যাব। ওই সময় তার বাসা থেকে ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও এক কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার হয়। ক্যাসিনো কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করে র্যাব। তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবলে অল্প সময়ের মধ্যেই কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন পাগলা মিজান। বাইরে বের হয়ে আবারও বীরদর্পে নিজের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন মিজান। ওই মামলটি তদন্ত করে অভিযোগপত্র সিআইডি। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জজ আদালতে বিচারাধীন।
আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সরাসরি দেখা করা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ক্ষুদে বার্তার উত্তরও দেননি।
ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আইনের চোখে অপরাধী বা মামলার আসামি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পিছপা হবে। সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার আমাদের অভিযান চলমান। আত্মগোপনে থাকা পাগলা মিজানকে পুলিশ দ্রুতই গ্রেপ্তারে সক্ষম হবে।
আপনার মতামত লিখুন :