ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার রুবেল ইসলাম। ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে লোক পাঠানোর নাম করে তাদের পাঠাতেন লিবিয়া। সেখানে তাদের বন্দি করে নির্যাতনের মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে নিতেন মোটা অংকের মুক্তিপণ। আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সদস্য রুবেল ইসলাম এভাবেই পেয়েছিলেন যেন আলাদিনের চেরাগ। অল্প দিনের মধ্যেই বনেছেন অন্তত ৩০ কোটি টাকা সম্পত্তির মালিক। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের ঘনিষ্ঠ এবং নিজেও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিধায় তার ভয়ে মুখ খোলার সাহত পেতেন না ভুক্তভোগীরা। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ময়মনসিংহসহ আশপাশের কয়েক জেলায় ছড়িয়েছিলেন নিজের জাল। সম্প্রতি মানবপাচারের এক মামলায় গত মঙ্গলবার রুবেল ইসলাম র্যাব-১৪ এর হাতে গ্রেপ্তারের পর এসব ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে আসে।
মানবপাচারকারী রুবেল ইসলাম উপজেলার নিগুয়ারী ইউনিয়নের আব্দুস সোবহানের ছেলে। তাকে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারি চক্রের সদস্য বলে দাবি করেন ভুক্তভোগীদের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার শক্তিশালী হাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার প্রতারণার শিকার দুই প্রবাসী।
গত বুধবার বিকেলে ময়মনসিংহ র্যাব-১৪ এর কার্যালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রুবেল ইসলামকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ময়মনসিংহ র্যাব-১৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সামসুজ্জামান বলেন, ‘সম্প্রতি মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানায় রুবেল ইসলামসহ ১১ জনের নকমে মানবপাচারের মামলা হয়। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করে র্যাব।’
মামলার নথির বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাদী রেহানা আক্তারের সঙ্গে রুবেল ইসলামের পরিচয় ছিল। ওই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে রুবেল বাদীর স্বজন ফাহমিদুলকে ইতালি পাঠাবেন বলে ২০ লাখ টাকা নেন। গত ৩১ মার্চ ফাহমিদুলকে ঢাকায় নিয়ে হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথমে দুবাই পরবর্তীতে দুবাই থেকে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লিবিয়ায় নেওয়ার পর ফাহমিদুলকে অজ্ঞাত মাফিয়া চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে অজ্ঞাত স্থানে আটক রেখে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করে টাকা আদায়ের জন্য। নির্যাতনের ছবি ইমুতে ভিডিওকলের মাধ্যমে দেখিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে ৮ কোটি টাকা দাবি করে। পরে আসামিরা বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আরও এক কোটি টাকা আদায় করে। এ ঘটনার পর রেহানা আক্তার বাদী হয়ে ১১ জনকে মাদারীপুর রাজৈর থানায় মামলা দায়ের করেন।’
মামলার পর র্যাব-১০ এর সহায়তায় ময়মনসিংহ জেলার পাগলা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে রুবেল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর আসামির বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান র্যাব এই কর্মকর্তা।
এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হক সম্প্রতি ঢাকার সেগুনবাগিচা দুদকের প্রধান কার্যালয়-১ এর চেয়ারম্যান বরাবর রুবেল ইসলামকে অভিযুক্ত করে মানবপাচার করে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ফ্যাসিস্ট সরকার আওয়ামী লীগের দোসর রুবেল ইসলাম মানবপাচার করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। সহজ সরল লোকদের ইতালি নেওয়ার কথা বলে প্রথমে দুবাই ও পরে লিবিয়া নিয়ে নির্যাতন করে পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন। এসব করে রুবেল অন্তত ৩০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হাত করে এসব কাজ করতেন।
অভিযোগে সংক্ষিপ্ত সম্পত্তির বর্ণনা উল্লেখ করা হয়, ভালুকার মাওনা পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে তিন কোটি টাকার সম্পত্তি, ১ নম্বর সিএমবিতে ১৪টি রুমসহ প্রায় আড়াই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, মাওনা চৌরাস্তার সঙ্গে ৩ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়াও নিগুয়ারিতে ১০ বিঘা সম্পত্তি যার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা, নিজের নতুন বাড়ি এক কোটি টাকা, এক কোটি টাকার দুটি গাড়িসহ নামে বেনামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এলাকায় অনেক মানুষকে ইতালি নেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি অর্জন করেছেন রুবেল। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেন না। যে কারণে আমি এলাকাবাসীর পক্ষ হয়ে দুদকে অভিযোগ করি।’
রুবেলের প্রতারণার শিকার মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাশখালী ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামের প্রবাসী মনির হোসেন রাসেল। তিনি বর্তমানে মালদ্বীপে অবস্থান করছেন। মোবাইলে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি আনুমানিক দেড় বছর আগে লিবিয়া যাই। সেখানে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার নিগুয়ারী গ্রামের মানবপাচারকারি রুবেল ইসলামের সঙ্গে এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে রুবেল আমাকে ইতালি পাঠাবে বলে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি লিবিয়া থাকা অবস্থায় আমার পরিবারের পক্ষ থেকে রুবেলকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। পরে রুবেল আমাকে লিবিয়ার দালালদের হাতে তুলে দেয়। ওই দালালরা আমাকে নির্যাতন করে আরও টাকা দাবি করে। আমি সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে দেশে ফিরে আসি। পরে রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে হুমকি দিতেন। পরবর্তীতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রুবেল আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারি চক্রের সদস্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ চক্রের সদস্য রয়েছে। দেশে ফিরে বেকার হয়ে পরে আবারও গত ৪ মাস আগে অন্যজনের মাধ্যমে মালদ্বীপ আসি। শুনেছি রুবেল গ্রেপ্তার হয়েছে। আমি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলব।’
রুবেল ইসলামের প্রতারণার শিকার মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাঁশখালী ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামের বাসিন্দা এনামুল মিয়া। বর্তমানে তিনি লিবিয়ায় পলাতক অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। তিনি না পারছেন ইতালি যেতে, না পারছেন দেশে ফিরতে। তিনি বলেন, ‘রুবেল আমাকে ইতালি পাঠাবে বলে জানালে আমার সঙ্গে ২০ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। এর মধ্যে প্রথমে সাত লাখ টাকা দেই রুবেলকে। আনুমানিক তিন মাস আগে রুবেল আমাকে প্রথমে দুবাই পাঠায়, সেখান থেকে লিবিয়ায় যাই। লিবিয়া যাওয়ার পর রুবেল আমার কাছে আবারও ২০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় আসাকে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেয়। মাফিয়া চক্র আমাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে বলে। আমার পরিবার ১০ লাখ টাকা দেয়। পরে আমি কৌশলে মাফিয়া চক্রের হাত থেকে পালিয়ে আসি। পালিয়ে আসার পর রুবেলের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি। আমি এখন লিবিয়ায় পলাতক অবস্থায় আছি। এখানে মানবেতর জীবনযাপন করছি। টাকার অভাবে দেশে ফিরতে কিংবা ইতালি যেতেও পারছি না। রুবেল গ্রেপ্তার হয়েছে, এ খবর পেয়েছি। আমি তার কঠিন শাস্তি দাবি করছি। আমার মতো কেউ যেন এমন প্রতারণার শিকার না হয়।’
রাজৈর থানার ওসি মোহাম্মদ মাসুদ খান বলেন, মানবপাচার চক্রের ১১ সদস্যকে আসামি করে মামলার পর রুবেল ইসলামসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপর আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজৈর থানায় মানবপাচার মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে, ভিক্টিম ফাহমিদুল এখনো লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের হাতে বন্দি। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি। শিবচর থানা এলাকায় কেউ যদি ওই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে, ভুক্তভোগিরা মামলা করলে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

