ঢাকা বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

বিশ্ব ক্রিকেটে মিচেল জনসনের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প

ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৫, ০৪:২৯ পিএম
অজি সাবেক তারকা পেসার মিচেল জনসন। ছবি- সংগৃহীত

ক্রিকেট বিশ্বে পেসারদের আলাদা একটা অবস্থান থাকে। কিন্তু মিচেল জনসনের কথা উঠলেই শিরদাঁড়ায় এক শীতল স্রোত বয়ে যায়! তাঁর ধ্বংসাত্মক গতি, নিখুঁত লাইন ও লেংথ আর আগ্রাসী শরীরী ভাষা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কাঁপিয়ে তুলতো। কিন্তু কীভাবে এই অস্ট্রেলিয়ান বোলার হয়ে উঠলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা? ফিরে দেখা যাক জনসনের অনন্য ক্রিকেট যাত্রা।

একটি ফোনকল বদলে দিল জীবন

মিচেল জনসনের জীবন এক ঘূর্ণিপাকের মতো বদলে যায় ১৭ বছর বয়সে। তিনি তখন মূলত টেনিস খেলতেন। কিন্তু একদিন তাঁর বোলিং দেখার সুযোগ পান কিংবদন্তি ডেনিস লিলি।

সঙ্গে সঙ্গেই লিলি বিস্ময়ে বলেছিলেন, ‘আমি এমন কিছু দেখিনি অনেকদিন!’ এরপর লিলি নিজে জাতীয় ক্রিকেট একাডেমির সাথে যোগাযোগ করেন, আর শুরু হয় মিচেল জনসনের ক্রিকেট যাত্রা।

জনসনের ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন

জনসনের ক্যারিয়ার শুরুটা ছিল ধীরগতির। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেক হলেও চোট, ছন্দহীনতা আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে থেমে থেমে চলছিল তাঁর পথচলা।

২০০৯ অ্যাশেজে হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো এখানেই শেষ।

রাত-দিন পরিশ্রম করে জনসন নিজের বোলিংয়ে ফের আনলেন আগুনের ঝাঁজ

কিন্তু জনসন ছিলেন ভিন্ন মনের মানুষ। তিনি ফিরে গেলেন বেসিকে, নিজেকে গড়লেন নতুন করে। কোচ ও ব্যক্তিগত ট্রেনারদের সঙ্গে রাত-দিন পরিশ্রম করে তিনি নিজের বোলিংয়ে ফের আনলেন আগুনের ঝাঁজ।

২০১৩-১৪ অ্যাশেজ: পুণর্জন্মের গল্প

ক্রিকেট ইতিহাসে ২০১৩-১৪ অ্যাশেজ সিরিজটিকে মিচেল জনসনের ‘পুনর্জন্ম’ বলা হয়। পাঁচ ম্যাচে ৩৭ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে কার্যত ধ্বংস করে দেন এই বাঁহাতি পেসার।

তাঁর আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল তখনকার ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ। কেভিন পিটারসেন, অ্যালিস্টার কুক, জো রুট কেউই রক্ষা পায়নি তাঁর তাণ্ডব থেকে।

তাঁর সেই বোলিংকে ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়েফেয়ার’ বলেছিলেন অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক। পিচ, কন্ডিশন, কিংবা ব্যাটার, সবকিছুকে অতিক্রম করে শুধুমাত্র গতি, অ্যাঙ্গেল ও মনস্তত্ত্ব দিয়ে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তিনি।

টেস্ট ক্রিকেটে মিচেল জনসনের বিস্ময়কর পারফরম্যান্স

মিচেল জনসন যখন মাঠে প্রবেশ করতেন, তখন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা যে কোনো সময় দিশাহীন হয়ে পড়তেন। ৭৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলে তিনি নিয়েছেন ৩১৩টি উইকেট, যেখানে তার সেরা বোলিং ফিগার ছিল ৫১ রানে ৮ উইকেট।

এমন কার্যকারিতার সঙ্গে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে তার যেভাবে আগ্রাসন সৃষ্টি ছিল, তা ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

৭৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলে জনসন নিয়েছেন ৩১৩টি উইকেট

ওয়ানডে ক্রিকেটে মিচেল জনসনের ভয়ঙ্কর গতি

ওয়ানডে ক্রিকেটেও মিচেল জনসন ছিলেন এক অপরাজেয় শক্তি। তিনি ১৫৩টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে তার উইকেট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩৯টি।

ওয়ানডে ক্রিকেটে তার সেরা বোলিং পারফরম্যান্স ছিল ২৬ রানে ৬ উইকেট। বিশ্বকাপ ২০১৫-এ তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল অস্ট্রেলিয়ার শিরোপা জয়ে এক অবিস্মরণীয় দিক।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মিচেল জনসনের ভূমিকা

এমনকি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ৩০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন এবং শিকার করেছেন ৩৮টি উইকেট। যদিও টি-টোয়েন্টিতে তার ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম, তবে সেখানে তার বোলিং শক্তি কখনও অনুধাবন করার সুযোগ দেয়নি।


পুরস্কার ও স্বীকৃতি

২০১৪ সালে আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন মিচেল জনসন। একই বছর তিনি আইসিসি বর্ষসেরা টেস্ট বোলারও হন। তার চেয়েও বড় স্বীকৃতি পান, তিনি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিলেন।

চিরচেনা ২২ গজ থেকে অবসর 

২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন জনসন। কিন্তু তাঁর প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী প্রজন্মের পেসারদের জন্য তিনি হয়ে উঠেছেন এক আদর্শ।

তাঁর বোলিং অ্যাকশন, মানসিক দৃঢ়তা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষমতা আজও অনুপ্রেরণা দেয় বিশ্বজুড়ে তরুণ বোলারদের।

মিচেল জনসনের গল্প শুধুমাত্র একজন বোলারের নয়, এটা এক যোদ্ধার গল্প

মিচেল জনসনের গল্প শুধুমাত্র একজন বোলারের নয়, এটা এক যোদ্ধার গল্প। যিনি বারবার নিজের দুর্বলতাকে জয় করে উঠে এসেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের শিখরে।

তাঁর বলের গতির ঝড় যেমন ব্যাটসম্যানদের দিশেহারা করতো, তেমনি তাঁর অবসরও হৃদয় ছুঁয়ে যায় ক্রিকেট প্রেমীদের।