সুদানে দেড় বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। পশ্চিম দারফুরের এল-ফাশের শহরে সাম্প্রতিক গণহত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্ষোভের প্রেক্ষাপটে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাবিত তিন মাসের মানবিক যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে আরএসএফ।
১৮ মাস ধরে চলা এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, দেশটির একাধিক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি ভয়াবহভাবে বেড়ে উঠছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে আরএসএফ জানায়, ‘যুদ্ধের বিপর্যয়কর মানবিক পরিণতি মোকাবিলা এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা বৃদ্ধির জন্য আমরা এই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছি।’
তাদের দাবি, এই বিরতি দেশের সর্বত্র মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ উন্মুক্ত করবে। এই উদ্যোগটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমন্বয়ে গঠিত ‘কোয়াড’ মধ্যস্থতাকারী দলের পক্ষ থেকে।
তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের—আরএসএফ ও সুদানি সেনাবাহিনীর (এসএএফ)—সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে, যাতে মানবিক বিরতি বাস্তবে কার্যকর হয়।

গত সপ্তাহে আরএসএফ পশ্চিম দারফুরের এল-ফাশের শহর পুরোপুরি দখল করে নেয়। এরপরই সেখানে ভয়াবহ গণহত্যার খবর প্রকাশ পায়। পালিয়ে আসা বেসামরিক নাগরিকদের বর্ণনা ও স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, শহরে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং গণকবরে লাশ পুঁতে রাখা হয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, মৃতদেহের স্তূপের পাশে বালিতে রক্তের দাগ স্পষ্ট দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, এল-ফাশেরের একটি হাসপাতালে অন্তত ৪৬০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং চিকিৎসক ও নার্সদের অপহরণ করা হয়েছে।
এল-ফাশেরের এই হত্যাযজ্ঞে জাতিগত নিধনের উপাদান রয়েছে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলের যুদ্ধাপরাধ ও যৌন সহিংসতার প্রমাণ সংগ্রহ শুরু করেছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আরএসএফের প্রধান অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহায়তাকারী হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) নাম উঠে এসেছে। তবে ইউএই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র আরএসএফ সদস্যদের গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে এর নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি)-র ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দাগালো ২০১৯ সালে সাবেক শাসক ওমর আল-বশিরকে অপসারণে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ বুরহান-এর সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সুদানি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা কেবল তখনই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে যদি আরএসএফ বেসামরিক এলাকা থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করে এবং অস্ত্র জমা দেয়। এ কারণে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই ঘোষিত যুদ্ধবিরতি হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

তবে মধ্যস্থতাকারীরা আশাবাদী যে সৌদি আরবে আসন্ন নতুন আলোচনায় এই যুদ্ধবিরতিকে স্থায়ী শান্তিচুক্তিতে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল সেনাবাহিনী ও আরএসএফের একীভূতকরণ পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধ। সেনাপ্রধান জেনারেল বুরহান এবং তার সাবেক ডেপুটি দাগালো—দুজনই একসময় একই শিবিরে ছিলেন। কিন্তু বেসামরিক সরকারে রূপান্তর ও ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে।
এই ক্ষমতার লড়াই এখন রূপ নিয়েছে এক বিধ্বংসী মানবিক বিপর্যয়ে, যা জাতিসংঘের মতে আধুনিক আফ্রিকার অন্যতম ভয়াবহ সংঘাতে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির এই ঘোষণা সুদানে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্যে এক ক্ষীণ আশার আলো জ্বালালেও, বাস্তবতায় শান্তির পথ এখনো কঠিন। রাজনৈতিক অবিশ্বাস, আন্তর্জাতিক জটিলতা এবং জাতিগত বিভাজনের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি কতটা টিকে থাকবে, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
সূত্র: এনবিসি নিউজ

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন