ঢাকা রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫

অস্তিত্ব হারিয়েছে খাল! দখল হচ্ছে কীর্তনখোলা

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৫, ১১:৩৬ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‘ধান নদী খালা-এই তিনে বরিশাল’। একসময় বরিশালকে চেনাতে এই প্রবচন ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে আলোচিত প্রবচনটির মিল খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া অধিকাংশ খাল এরই মধ্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে। প্রতিনিয়ত দখল দূষণে ছোট হয়ে আসছে নগরসংলগ্ন শান্ত-স্নিগ্ধ কীর্তনখোলা।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে শহর লাগোয়া কীর্তনখোলা নদীর উভয় তীর দখলে একধরনের উৎসব শুরু হয়। দখল-পরবর্তী নদীতীরে অবৈধভাবে ডকইয়ার্ডসহ অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলেও জেলা প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি, যা পরিবেশবিদদের হতাশ করেছে।

প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় যে যার মতো করে নদী দখল শুরু করেছে, পূর্বে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সাড়ে ৪ হাজার দখলদারের তালিকা প্রকাশ করলেও এই সংখ্যা এখন ১০ হাজারের বেশি। একদিকে দখল, অন্যদিকে কলকারখানার বর্জ্য ফেলে দূষণ করায় ১৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪৯৭ মিটার গড় প্রস্থেও কীর্তনখোলা নদী ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে।

এদিকে, পরিবেশবিদেরা দখল-দূষণ রোধকল্পে দীর্ঘদিন নানা কর্মসূচি পালন করাসহ নদীতীরবর্তী বাসিন্দাদের সচেতনতামূলক পরামর্শ দিয়ে এলেও অবৈধ স্থাপনা সরানো যাচ্ছে না, বরং দিনে দিনে দখলসন্ত্রাস বাড়ছে, যা ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশি মাত্রায় দেখা যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে বরিশাল শহরের অভ্যন্তরে ১০৮টি খাল থাকলেও তা কমতে কমতে ২৩টিতে এসে ঠেকেছে। সরকারি হিসাবে ২৩টি খালের তথ্য থাকলেও এখন অধিকাংশই দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারিয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি সমান্তরালভাবে নগরসংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতীরও দখল হয়ে যাচ্ছে।

শহরের ছয়টি প্রধান খাল ২০২৩ সালের শেষ দিকে খননের উদ্যোগ নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কিন্তু আওয়ামী লীগ শাসনামলে ছয় কোটি টাকার সেই খননকাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে খালগুলো অর্ধখনন করে ফেলে রাখা হয়, যা এখন পরিত্যক্ত ডোবায় রূপ নিয়ে নগরবাসীকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। শহরের ফুসফুসখ্যাত খাল অস্তিত্ব হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বরিশালের প্রাণ কীর্তনখোলা নদীও দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নগরবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন ২৩ একর ভূমি নিয়ে বিস্তৃত রসুলপুর চরটিতে ৩ হাজারের বেশি অবৈধ বসতি রয়েছে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় এই চরের জমিসহ নদী দখল করার অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক নেতাকর্র্মীদের বিরুদ্ধে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সেই দলের কর্মীরাই চরটিতে দখলসন্ত্রাস চালায়, সঙ্গে নদীতেও বাঁশের বেড়া দিয়ে মাটি ফেলে দখল করে নেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাস ছয়েক আগে এই চরের ভূমিসহ নদীর বড় একটি অংশ দখল করে নেন মৎস্যজীবী লীগের নেতা খান হাবিব। সেখানে বিশালাকারের সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সেই সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে এখন একাধিক ব্যক্তি ভূমিটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। এ ছাড়া চরটির চারদিকে নদীতীরও দখল করা হয়েছে, এই দখল মচ্ছবে জড়িতদের অধিকাংশেরই দলীয় পদ-পদবি না থাকলেও তারা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

রসুলপুরের একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, চরে নতুন ভূমি জাগলেই রাজনৈতিক পরিচয়ে দখল করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দখলসন্ত্রাস অনেকাংশে বেড়েছে। প্রশাসনের তৎপরতা না থাকায় অনেকে নদী আটকে চর দখলে নিচ্ছে। একই অভিযোগ করেছেন শহরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ধান গবেষণা রোডের বাসিন্দারাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, আওয়ামী লীগ শাসনামলে এলাকার প্রভাবশালী বাসিন্দা রাইভিউল কবির স্বপন নদীতীর দখল করে সেখানে একটি ডকইয়ার্ড করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা স্বপনের সেই স্থাপনা তৎসময়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বরিশাল সিটি করপোরেশন। এরপরে দীর্ঘদিন সেই স্থান খালি পড়ে থাকলেও ৫ আগস্টের পরে স্বৈরাচারের দোসর স্বপন সেখানে ফের স্থাপনা নির্মাণ করাসহ ডকইয়ার্ড করছেন, যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও প্রশাসন নেয়নি কোনো ব্যবস্থা।

শুধু রসুলপুর, মোহাম্মদপুর বা ধান গবেষণা নয়, কালিজিরা টু চরমোনাই গোটা নদীর দুই পাড়জুড়েই হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত নদীর উভয় তীরে নতুন নতুন দখলদারের উৎপাত দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে একশ্রেণির ব্যক্তিবিশেষকে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে নদী দখল করে ইট-বালু-পাথর বিক্রির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে দেখা গেছে।

এ ছাড়া গ্লোবাল ক্যাপসুল লিমিটেড, কেমিস্ট ল্যাবরেটরি লিমিটেড, অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড, রেফকো ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বেশ কিছু কলকারখানা কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত। এসব কারখানার সুয়ারেজ লাইন কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবহৃত বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্য সরাসরি পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। 

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী কীর্তনখোলা নদীর অব্যাহত দখল-দূষণ নিয়ে সংক্ষুব্ধ পরিবেশবিদেরাও। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘ বছর ধরে এই দখল প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও তা রোহিতকরণে সরকারের তরফ থেকে বড়সড় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের শেষ দিকে আন্দোলকারীদের চাপের মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ নামকাস্তে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেলেও পরবর্তীতে ফের দখল হয়ে যায়।

বিশেষ করে সরকার পরিবর্তনের পরে নদী দখলে প্রভাবশালীদের দৌড়ঝাপ নিয়ে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী  সরকার দেশের নদীপাড়ের অবেধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়েছে, যা নিয়ে ইতিপূর্বে জেলা প্রশাসনের একটি সভায় আলোচনা হয়। কিন্তু হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, এরই মধ্যে দখলের পাশাপাশি দূষণও বেড়েছে, সেই সঙ্গে নদী থেকে বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যত্রতত্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ হারানোসহ ভাঙনঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলন রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলুও নদী দখল-দূষণ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এই পরিবেশবিদ অভিযোগ করে বলেন, কীর্তনখোলা নদীর আশপাশ দখলে যারা জড়িত, তারা সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আছেন। যখন যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তারাই দখলসন্ত্রাসে এক কদম এগিয়ে থাকেন। দুই পরিবেশবিদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া কিছুটা হলেও জানান দেয় বরিশালের প্রাণ কীর্তনখোলায় কী পরিমাণ দখল মচ্ছব চলমান, যা নিয়ে এখন সরব হয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামও।

তিনি আরও জানান, কীর্তনখোলা নদী দূষণমুক্ত রাখতে কলকারখানাগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তর মিলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে নদীদূষণ রোধে কাজ করা হবে। পরিবেশগতভাবে বরিশালকে সুরক্ষিত রাখার এই কর্মযজ্ঞ কবে শুরু হবে, তার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলতে পারছেন না মুজাহিদুল ইসলাম।

তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, কীর্তনখোলা দখলমুক্ত করাসহ দূষণ রোধে অচিরেই বড়সড় পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যা নিয়ে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক সেলিম রেজা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অতীতে দখলদারদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়, সেখানে সাড়ে ৪ হাজার ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু এই তালিকা কয়েক গুণ বেড়েছে, তবে এর সঠিক সংখ্যা কত তা অনুসন্ধান ছাড়া বলা মুশকিল।

কিন্তু দখলদার যারাই হোক, আর তাদের পরিচিতি যা-ই হোক না কেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সে ক্ষেত্রে স্থাপনা উচ্ছেদসহ দখলদারদের মামলায় আসামি করার বিষয়টিও সুপারিশে রাখা হয়েছে বলে জানান বন্দরের ওই কর্মকর্তা।

নদী দখলমুক্ত করতে বরিশাল জেলা প্রশাসনও তৎপর রয়েছে বলে জানা গেছে। সরকার পরিবর্তনের পরে অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, নদী দখল ও দূষণ রোধে শিগগিরই দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাবে। পাশাপাশি শহরের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো উদ্ধারে চিন্তা রয়েছে, কিছুদিন আগে এর জন্য বাজেটও চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।