ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদবিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যেটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে বহুদিন ধরে প্রচারিত হচ্ছিল।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) এ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজসম্পদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকার পাবে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য একটি যৌথ বিনিয়োগ তহবিল গঠন করা হবে।
ওয়াশিংটনে বহু মাসের টানাপোড়েনপূর্ণ আলোচনা শেষে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়, যা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল।
এই চুক্তি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে কাজ করছেন এবং ইউক্রেন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন, যেটি তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এবং ইউক্রেনের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া সভিরিদেনকো এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক ছবিতে তাদের স্বাক্ষরের দৃশ্য দেখা যায়। মন্ত্রণালয় জানায়, ‘এই চুক্তি স্পষ্ট করে মার্কিন প্রশাসনের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ ইউক্রেনের প্রতি প্রতিশ্রুতি।’
সভিরিদেনকো বলেন, চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র শুধু আর্থিক সহায়তা প্রদানই করবে না, বরং নতুন সহায়তাও দেবে, যেমন- ইউক্রেনের জন্য বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যদিও মার্কিন সরকার সরাসরি এই বিষয়ে কিছু বলেনি।
রাশিয়ার ২০২২ সালের পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সর্ববৃহৎ সামরিক সহায়তাকারী, যার পরিমাণ ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে (কিয়েল ইনস্টিটিউট, জার্মানি অনুযায়ী)।
চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে সহায়তা দিয়েছে, তার বিনিময়ে কিছু পাওয়া উচিত। সেই চিন্তা থেকেই ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ দুর্লভ খনিজসম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, এই অংশীদারিত্ব ‘যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় যে বিশাল আর্থিক ও উপাদানগত সহায়তা দিয়েছে, তা স্বীকৃতি দেয়।’
খনিজ উত্তোলনে ইউক্রেনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ
সভিরিদেনকো জানান, ইউক্রেনই নির্ধারণ করবে কোন খনিজ কোথায় উত্তোলন করা হবে এবং জমির নিচের সম্পদ ইউক্রেনেরই মালিকানায় থাকবে।
ইউক্রেনের মাটিতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ দুর্লভ খনিজ, যা বৈদ্যুতিক যানবাহন, ভোক্তা পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এই খনিজ উত্তোলনে বিশ্বে চীনের আধিপত্য রয়েছে, যেটি ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে আছে।
ইউক্রেনের ভূগর্ভে রয়েছে বিশাল পরিমাণ লোহা, ইউরেনিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদও।
সভিরিদেনকো বলেন, এই চুক্তির আওতায় ইউক্রেনের ওপর কোনো ঋণপ্রদান বাধ্যবাধকতা নেই, যা ছিল দীর্ঘ আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
তিনি আরও জানান, এই চুক্তি ইউক্রেনের সংবিধান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জনের প্রচেষ্টার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অবশ্য খনিজসম্পদ সংক্রান্ত এই চুক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিপ্রচেষ্টা পৃথকভাবে পরিচালিত হলেও উভয়ই ওয়াশিংটনের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ।
ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার প্রতি আগের তুলনায় নমনীয় অবস্থান নিয়েছে এবং কখনো কখনো ভুলভাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছে।
মার্কিন শান্তি প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়া এবং আরও চারটি অঞ্চলের ওপর দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব ছিল, যেটি ইউক্রেনের সংবিধানের পরিপন্থি হওয়ায় জেলেনস্কি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সভিরিদেনকো বলেন, ‘এই চুক্তি বৈশ্বিক অংশীদারদের কাছে একটি বার্তা পাঠায় যে, ইউক্রেনের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা শুধু সম্ভবই নয়, বরং নির্ভরযোগ্যও।’
রয়টার্স প্রাপ্ত একটি খসড়া চুক্তিতে দেখা যায়, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অতীতের সামরিক সহায়তার কোনো অর্থ ফেরত দেওয়ার শর্ত থেকে মুক্তি পেয়েছে, যা কিয়েভ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
তবে চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো নির্দিষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নেই, যা ছিল ইউক্রেনের প্রাথমিক চাহিদার অন্যতম।
পাশাপাশি, ইউক্রেন ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যেন একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা যায়, যদি কোনো শান্তিচুক্তি হয়।
আপনার মতামত লিখুন :