বিশ্বজুড়ে যখন শুক্রবার (৩ মে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সময় অনুযায়ী) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস’, তখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর), অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে এক কঠিন সতর্কবার্তা দিয়েছে- গাজায় সাংবাদিক হত্যা, আটক এবং হয়রানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে।
জাতিসংঘের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত ২১১ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৮ জন নারী সাংবাদিক রয়েছেন।
ইউনেস্কোর তথ্যমতে, অন্তত ৪৭ জন সাংবাদিক সরাসরি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে ৪৯ জন সাংবাদিক ইসরায়েলের বিভিন্ন আটক কেন্দ্রে বন্দি রয়েছেন।
একজন স্থানীয় সাংবাদিক জাতিসংঘকে বলেছেন, ‘প্রেস লেখা জ্যাকেট এখন আর রক্ষাকবচ নয়, বরং হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।’
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী সাংবাদিকদের সরাসরি লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছে, এমন ‘প্রমাণযোগ্য ইঙ্গিত’ রয়েছে- যা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন ও যৌন সহিংসতা
আটক হওয়া সাংবাদিকরা জাতিসংঘকে জানিয়েছেন, তাদের নির্যাতন, অপমান এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মুখে পড়তে হয়েছে। তাদের সাংবাদিকতাকেই অপরাধ হিসেবে তুলে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এই নির্যাতন, জাতিসংঘের ভাষায়, ‘ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো ও কলঙ্কিত করার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।’
গাজায় সাংবাদিকতা মানেই জীবন নিয়ে বাজি ধরা
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ করতে দেয়নি, শুধু সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত সীমিত পরিদর্শনের অনুমতি দিয়েছে।
ফলে স্থানীয় সাংবাদিকরাই জীবন ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করছেন- একদিকে নিজের পরিবারকে বাঁচানোর লড়াই, অন্যদিকে ইসরায়েলি হামলার মধ্যে থেকে হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য সংগ্রহ।
পশ্চিম তীরে মতপ্রকাশে দমননীতি
অধিকৃত পশ্চিম তীরে, বিশেষ করে জেনিন শরণার্থী শিবিরে সাংবাদিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানি, গ্রেপ্তার ও সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিচ্ছে, অনেক সময় বিনা কারণে আটক বা শারীরিকভাবে আক্রমণ করছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেছে, অভিযোগে- তারা ‘উসকানি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য’ প্রচার করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা জেনিনে ছয় সপ্তাহব্যাপী নিরাপত্তা অভিযানের সমালোচনার প্রেক্ষাপটে আসে।
আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও জবাবদিহির দাবি
জাতিসংঘ বলেছে, এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মানবিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং একইসঙ্গে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে চলমান অপরাধের বিরুদ্ধে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করছে।
‘সাংবাদিকদের হত্যা, আটক এবং হয়রানি বন্ধ করতে হবে। দোষীদের আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
জাতিসংঘের বক্তব্য, ‘সংঘাতের সময় গণমাধ্যম অপরাধ উন্মোচন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের স্তব্ধ করার যেকোনো চেষ্টাই অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তা বরদাশত করা উচিত নয়।’
গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরায়েল
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৫২,৪০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) গত নভেম্বর মাসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) গণহত্যার মামলা চলমান।
আপনার মতামত লিখুন :