ঢাকা সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

বাংলাদেশি পণ্য আমদানি বিধিনিষেধ: যা বলছে ভারতের মিডিয়া?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৫, ১১:৪১ এএম
স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ভারতের। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। দেশটি শনিবার (১৭ মে) জানায়, তাদের স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য আমদানি করা যাবে না। ভারতের বেশির ভাগ মূল ধারার সংবাদমাধ্যম সেটিকে একটি ‘রেসিপ্রোকাল মুভ’ বা ‘পাল্টা পদক্ষেপ’ হিসেবেই বর্ণনা করছে।

তাদের দাবি, সম্প্রতি ঢাকা ভারতের রপ্তানিতে যেসব অশুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) আরোপ করেছে, তার জবাবেই দিল্লির এই সিদ্ধান্ত- ভারত নিজে থেকে এটি নেয়নি।

কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বা সেভেন সিস্টার্সকে ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে অভিহিত করেন এবং বাংলাদেশকে ওই অঞ্চলের জন্য ‘সমুদ্রের অভিভাবক’ হিসেবেও দাবি করেন।

ভারতের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম অধ্যাপক ইউনূসের ওই মন্তব্যের সঙ্গেও দিল্লির সর্বশেষ সিদ্ধান্তের সম্পর্ক টানছেন।

বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব নিত্যনতুন কড়াকড়ি যে দুই দেশের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্রমাবনতিরই প্রতিফলন, তা নিয়েও ভারতের প্রধান খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।

ভারতের প্রথম সারির কয়েকটি সংবাদমাধ্যম দিল্লির এই সিদ্ধান্তকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে, এই প্রতিবেদনে সেটাই সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারকে ‘বার্তা দিতেই’ এই সিদ্ধান্ত : দ্য হিন্দু

দ্য হিন্দুর দিল্লি সংস্করণে এটি আজকের (১৮ মে) প্রধান খবর। শিরোনাম হলো, ‘সব স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বন্ধ করে দিল ভারত’।

খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি চীন সফরে মুহাম্মদ ইউনূসের করা মন্তব্যের পটভূমিতেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘একটি বার্তা দিতেই’ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে পত্রিকাটিকে জানানো হয়েছে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাসহ ভারতে আরও অনেকেই যে ওই মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দ্য হিন্দুকে সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, সম্প্রতি ভারত থেকে কটন ইয়ার্ন আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক কড়াকড়ি চালু করেছে-স্থলবন্দরগুলোতে এই সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে শুধু সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করতে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, তা ছাড়া ভারতের পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে বাংলাদেশের দিকে ‘অ্যাগ্রেসিভ ইনস্পেকশন’ বা কড়া তল্লাসির মুখে পড়তে হচ্ছে বলেও দিল্লি লক্ষ্য করেছে। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই ভারত গত শনিবারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন।

তৈরি-পোশাকসহ যেসব ‘নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর এই বিধিনিষেধ জারি করা হচ্ছে, সেই তালিকাও কিছু দিন পর পর পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলে ‘দ্য হিন্দু’ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

‘ব্লো টু বাংলাদেশ’ : দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া

এই খবরটি ভারতের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াতেও প্রথম পাতায় ঠাঁই পেয়েছে এবং তারা ভারতের এই সিদ্ধান্তকে ‘ব্লো টু বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশের জন্য বড় আঘাত) বলে বর্ণনা করেছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়াও এটিকে একটি ‘রিটালিয়েটরি মুভ’ বা প্রত্যাঘাতমূলক পদক্ষেপ বলে মনে করছে। অর্থাৎ তাদের মতে ভারত নিজে থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি, বাংলাদেশের পদক্ষেপের জবাব দিতেই এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

তারা আরও মনে করিয়ে দিচ্ছে, গত মাসেই বাংলাদেশ ভারত থেকে ইয়ার্ন (যা পোশাক তৈরির অপরিহার্য কাঁচামাল) ও চাল আমদানিতে বিধিনিষেধ চাপিয়েছিল। তারও আগে অবশ্য ভারত তাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য পাঠানোর সুযোগ (ট্রান্সশিপমেন্ট) প্রত্যাহার করে নেয়।

দিল্লিতে এক সরকারি কর্মকর্তা পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘দ্বিপাক্ষিক এনগেজমেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজের সুবিধামতো ‘চেরি-পিক’ করবে (মানে শুধু নিজের পছন্দেরটা বেছে নেবে) কিংবা ভারতের বাজারে অ্যাকসেস পাওয়া যাবেই বলে ধরে নেবে- এটা মেনে নেওয়া যায় না।’

তবে ওই কর্মকর্তা এটাও জানিয়েছেন যে, ভারত এসব ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত কিন্তু পরিবেশে যাতে কোনো তিক্ততা না থাকে সেটা নিশ্চিত করা বাংলাদেশেরই দায়িত্ব।

‘রেসিপ্রোকাল মুভ’ : দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ভারতের প্রথম সারির আরেক দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসও দিল্লির এই সিদ্ধান্তকে ‘রেসিপ্রোকাল মুভ’ বলে বর্ণনা করেছে। তাদের মতে, গত মাসে বাংলাদেশ ভারতের রপ্তানিতে যেসব নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার (অশুল্ক বাধা) বসিয়েছে, তার জবাবেই এই পদক্ষেপ।

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের অপসারণের পর এই সিদ্ধান্তকে ঢাকার বিরুদ্ধে দিল্লির সবচেয়ে শক্তিশালী পুশব্যাকগুলোর (ধাক্কা) অন্যতম বলেও বর্ণনা করেছে পত্রিকাটি।

বেইজিংয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতকে মুহাম্মদ ইউনূসের ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে বর্ণনা করার মাত্র মাসদেড়েকের মধ্যেই যে এই সিদ্ধান্ত এলো, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছে ওই পত্রিকাটি।

চীনের অর্থনীতির সম্প্রসারণের পটভূমিতেই যে অধ্যাপক ইউনূস ওই মন্তব্য করেছিলেন, সে কথাও তারা উল্লেখ করেছে।

রেডিমেড গার্মেন্ট থেকে শুরু করে কটন ইয়ার্ন এই নতুন বিধিনিষেধের আওতায় পড়লেও মাছ, ভোজ্যতেল বা গুঁড়ো পাথরের মতো পণ্য কড়াকড়ি থেকে ছাড় পেয়েছে বলেও জানিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

বাংলাদেশ থেকে ৪২% আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে : দ্য ইকোনমিক টাইমস

ভারতের প্রথম সারির অর্থনৈতিক পত্রিকা দ্য ইকোনমিক টাইমস জানাচ্ছে, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ থেকে মোট আমদানির ৪২ শতাংশই বাধাপ্রাপ্ত হবে- আর্থিক অঙ্কে যার পরিমাণ অন্তত ৭৭ কোটি ডলার।

ট্রেড রিসার্চ গ্রুপ ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’-কে (জিটিআরআই) উদ্ধৃত করে তারা এই পরিসংখ্যান দিচ্ছে।

দ্য ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে এখন প্রতি বছর ভারতে ৬১.৮ কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়। যেটা এরপর থেকে কলকাতা ও নাভা সাভা (মুম্বাই) সমুদ্রবন্দর ছাড়া আর কোনো রুটে আনা যাবে না।

কিন্তু এই দুটো রুটই স্থলবন্দরের তুলনায় অনেক বেশি খরচ ও সময়সাপেক্ষ। ফলে বাংলাদেশ থেকে আমদানি স্বভাবতই নিরুৎসাহিত হবে।

বাণিজ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জিটিআরআই’র একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ওই পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, ঢাকার ডিপ্লোম্যাটিক পিভট’ বা কূটনৈতিক ভারসাম্য যে চীনের দিকে ঝুঁকছে- ভারতের এসব বিধিনিষেধ তারই উত্তর বলে মনে করা যেতে পারে।

ভারতের পোশাক রপ্তানিকারীরা খুশি হবেন : এনডিটিভি

ভারতের প্রথম সারির চ্যানেল এনডিটিভি বলছে, ভারতের অ্যাপারেল বা তৈরি পোশাক রপ্তানিকারীরা বহুদিন ধরেই সরকারের কাছে আর্জি জানিয়ে আসছিলেন বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক।

প্রথমে তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে এবং তারপর স্থলবন্দর বন্ধ করে দিয়ে সরকার তাদের দাবিই কার্যত মেনে নিল বলে এনডিটিভি-র প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। টেক্সটাইল খাতে ভারত ও বাংলাদেশকে পরস্পরের ‘বড় প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে।

চীনের মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যও ভারত ভালোভাবে নেয়নি, সে কথাও উল্লেখ করেছে এনডিটিভি।

তাদের বর্ণনায়, মুহাম্মদ ইউনূসের ওই বিতর্কিত মন্তব্যের পটভূমিতেই এর আগে গত ৯ এপ্রিল তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত বাতিল করেছিল।

কতটা প্রভাব পড়বে দিল্লির সিদ্ধান্তে : প্রশ্ন আনন্দবাজারের

কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত খবরটির শিরোনাম হলো: ‘স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে কত হাজার কোটির বাণিজ্য চলে বাংলাদেশের? কতটা প্রভাব পড়বে দিল্লির সিদ্ধান্তে?’

তারা ওই খবরে বলেছে, ভারত সরকারের নির্দেশিকা মেনে এখন থেকে পোশাক, তেল, ফল বা সুতো এ দেশে রপ্তানি করতে হলে বাংলাদেশের একমাত্র ভরসা জলপথ। তা ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এতে রপ্তানির পরিমাণ কমতে বাধ্য। ফলে বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

আনন্দবাজার আরও লিখেছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।

অভিযোগ, ইউনূসের আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বেড়ে গেছে বাংলাদেশে। এ নিয়ে ভারত সরকার একাধিকবার উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

কিছুদিন আগে ইউনূস চীন সফরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো সম্পর্কে তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিও নজর এড়ায়নি।

এর মাঝেই সম্প্রতি ভারত থেকে স্থলপথে সুতো আমদানি বন্ধ করে দেয় ঢাকা, তার পরেই নয়াদিল্লির এই সিদ্ধান্ত বলে জানাচ্ছে আনন্দবাজার।