ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে কয়েক দশকের বৈরিতা এক নতুন রূপ নিচ্ছে। শুক্রবার (১৩ জুন) রাত থেকে শুরু হওয়া পাল্টাপাল্টি হামলায় আজ শনিবার (১৪ জুন) মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় ইসরায়েল তাদের পুরনো শত্রু ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়- যার প্রধান লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি এবং শীর্ষ বিজ্ঞানী ও কমান্ডাররা। জবাবে ইরান ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ ৩’ চালু করে একই সঙ্গে চার ধাপে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে প্রাণহানির ভয়াবহ চিত্র
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০ জন শিশু। ইসরায়েলি শহরগুলোতেও একাধিক জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যার ফলে কমপক্ষে তিনজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যদি খামেনি ইসরায়েলি হোম ফ্রন্টে হামলা অব্যাহত রাখেন, তবে তেহরান পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।’
পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা, নিহত ৯ বিজ্ঞানী
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে, এজন্য ইরানের গুরুত্বপূর্ণ দুইটি পারমাণবিক স্থাপনা- এসফাহান ও নাতাঞ্জে হামলা চালানো হয়েছে। এতে অন্তত ৯ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো মেরামত করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে।
ইরান বলছে, এই হামলায় ৭৮ জন নিহত ও ৩২০ জন আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
রাজধানী তেহরানে রাত্রিভর বিস্ফোরণ
ইরানের রাজধানী তেহরানজুড়ে সারা রাত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ফারস নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, শহরের ভেতরে অবস্থিত মেহরাবান্দ বিমানবন্দরে দুটি প্রজেক্টাইল আঘাত করেছে। ১৪ তলা বিশিষ্ট ‘শাহিদ চামরান’ আবাসিক ভবন সম্পূর্ণ ধসে পড়ে, যার নিচে বহু মানুষ আটকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার ফলে আগামী রোববার (১৫ মে) পুনরায় শুরু হওয়ার কথা ছিল ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনা, তা এখন অনিশ্চয়তায়।
এ নিয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই বলেন, ‘যে পক্ষ সংলাপ চায়, তারা যেন ইসরায়েলকে আমাদের মাটিতে হামলা করতে উৎসাহ না দেয়।’
জাতিসংঘে ইরান জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলের হামলায় তারা আন্তর্জাতিক আইন ও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির (NPT) লঙ্ঘন করেছে।
তবে এ বিষয়ে ইসরায়েল দাবি করে জানিয়েছে, এই হামলা ছিল আত্মরক্ষার পদক্ষেপ।
গাজা-লেবাননে মিত্র হারাচ্ছে ইরান
হামাস ও হিজবুল্লাহ- দুই মিত্র গোষ্ঠীই বর্তমানে যুদ্ধাক্রান্ত ও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ইয়েমেনি হুথি গোষ্ঠী ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেও তার মধ্যে অন্তত একটি ক্ষেপণাস্ত্র ভুলবশত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে পড়লে তিন শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন।
বিশ্ববাজারে প্রভাব ও শান্তির আহ্বান
ইরান-ইসরায়েলের এই সংঘাতের ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম প্রায় ৭% বেড়ে গেছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। পোপ ফ্রান্সিসও উভয় পক্ষকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে ‘দায়িত্ববোধ ও যুক্তি’ অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কারো অস্তিত্ব কখনো অন্যের জন্য হুমকি হওয়া উচিত নয়। শান্তির পথে অগ্রসর হওয়া প্রতিটি জাতির নৈতিক দায়িত্ব।’
আপনার মতামত লিখুন :