চীনে তৈরি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বহু বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুর্ঘটনার উচ্চ হার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানটির পুরোনো কাঠামো, সীমিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আধুনিক নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে এটি তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমান ও সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা
বাংলাদেশও দীর্ঘদিন ধরে এফ-৭ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে। সম্প্রতি ঢাকার উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি এফটি-৭ বিজিআই মডেলের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর এই বিমান নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে আবারও উঠে এসেছে এই মডেলের উচ্চ দুর্ঘটনা হার।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে সেই তদন্ত কতদিন চলবে বা এতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয়নি।
এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য
এফটি-৭ বিজিআই বিমানটি চীনের চেংদু বিমান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। এর পূর্ণরূপ হলো- বাংলাদেশ, কাচের ককপিট এবং উন্নত সংস্করণ। এই মডেলটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।
এটি স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত, এক ইঞ্জিনচালিত ও দুই আসনের যুদ্ধবিমান। মূলত পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়, তবে প্রয়োজনে এটি যুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে।
বিমানটির সর্বোচ্চ গতি শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ। এটি প্রতি মুহূর্তে ৮২ কিলোনিউটন পর্যন্ত শক্তি উৎপাদন করতে পারে। পাইলটের সুবিধার্থে এতে রয়েছে উন্নত প্রদর্শনী ব্যবস্থা ও ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে পাইলট দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন।
বিমানটিতে যুক্ত করা হয়েছে আগুন নিয়ন্ত্রণ রাডার প্রযুক্তি, যা ৮৬ কিলোমিটারের দূরত্বে শত্রু শনাক্ত করতে পারে। একই সঙ্গে এটি ছয়টি লক্ষ্য ট্র্যাক করে এবং দুটি লক্ষ্যে এক সঙ্গে আঘাত হানতে সক্ষম।
এই বিমানে সাতটি অস্ত্র বহনের স্থান রয়েছে। এটি বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও বোমা বহনে সক্ষম। এমনকি এটি ৩ হাজার পাউন্ড ওজনের লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমাও বহন করতে পারে।
পুরনো প্রযুক্তি হলেও কিছু উন্নয়ন হয়েছে
এই বিমানটি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ এর প্রযুক্তির ভিত্তিতে তৈরি। ১৯৬৬ সালে এর প্রথম সফল পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন হয় এবং ১৯৬৭ সালে এটি চীনা সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়। যদিও ২০১৩ সালে এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
চীন বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী এফ-৭ এর একাধিক সংস্করণ তৈরি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যবহৃত মডেলটি উন্নত ও আধুনিক কিছু উপাদানযুক্ত। এটির কাঠামো ও প্রযুক্তি তৃতীয় প্রজন্মের হলেও কিছু কিছু সক্ষমতা চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের সঙ্গে তুলনীয়।
বিশ্বজুড়ে দুর্ঘটনার ইতিহাস
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এফ-৭ সিরিজের বিমানের অনেক দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি বড় দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পতেঙ্গায় এবং ২০১৮ সালে মধুপুরে দুটি দুর্ঘটনায় পাইলটের মৃত্যু হয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান, ইরান, জিম্বাবুয়ে, মিয়ানমারসহ বহু দেশেই এফ-৭ বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেক দেশ এরই মধ্যে এই মডেলকে বাদ দিয়েছে বা ধাপে ধাপে ব্যবহার কমিয়ে এনেছে।
প্রশিক্ষণ না যুদ্ধবিমান? বিভ্রান্তি দূর করল আইএসপিআর
২১ জুলাই উত্তরায় দুর্ঘটনায় পড়া বিমানটিকে কিছু সংবাদমাধ্যম ‘প্রশিক্ষণ বিমান’ হিসেবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, এটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিমান। শুধু প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হলেও এটি যুদ্ধের জন্যও সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল।
বিমান বিধ্বস্তের কারণ কী?
বিমান দুর্ঘটনার অনেক কারণ থাকতে পারে। আবহাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি কিংবা পাইলটের ভুল– যেকোনো কিছুই দায়ী হতে পারে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইসফাক ইলাহী জানান, বিমানটির কাঠামো পুরোনো হলেও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এটি অনেক উন্নত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেখানে চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের বিমান ব্যবহার করছে, সেখানে এই মডেলটি তুলনামূলকভাবে পুরোনো।
তার মতে, বাংলাদেশে এই বিমানগুলো ব্যবহারের একটি বড় কারণ হলো তুলনামূলক কম খরচ। দেশের বাজেট ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় এখনো এফ-৭ ব্যবহার করা হচ্ছে।
চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের দিকে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের কথা বলছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে চীনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ চীন থেকে জে-১০সি মডেলের আধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে।
এই মডেলটি এফ-৭ এর চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক ও সক্ষম। বাংলাদেশ ধাপে ধাপে ১৬টি জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করেছিল বলে জানা গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের মূল যুদ্ধবিমান হলো রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯। এর পরের অবস্থানে রয়েছে এফ-৭ এমজি। তবে বিমান বাহিনী চায় আরও উন্নত ও আধুনিক যুদ্ধবিমান যুক্ত করতে।
চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জে-১০ ছাড়াও আরও একটি কম খরচের যুদ্ধবিমান মডেল, এফসি-১, ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :