ইউক্রেন যুদ্ধে আহত রুশ সৈন্যদের বুধবার (২৯ অক্টোবর) দেখতে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ সময় তিনি জানান, রাশিয়া সফলভাবে ‘পসাইডন’ নামের একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সুপার টর্পেডোর পরীক্ষা চালিয়েছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্ত্র বিশাল তেজস্ক্রিয় সমুদ্রঢেউ তৈরি করে উপকূলীয় অঞ্চলকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
পুতিন বলেন, ‘এর মতো অস্ত্র বিশ্বের আর কোথাও নেই।’ প্রাচীন গ্রিক পুরাণের সমুদ্রদেবতা পসাইডনের নামে নামকরণ করা এই টর্পেডো সম্পর্কে খুব বেশি বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। তবে এটি মূলত একটি পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন টর্পেডো এবং ড্রোনের সংমিশ্রণ। রুশ পার্লামেন্টের এক জ্যেষ্ঠ সদস্যের ভাষায়, ‘পুরো একটি রাষ্ট্রকে অচল করে দিতে সক্ষম এই অস্ত্র।’
২০১৮ সালে প্রথমবার এই অস্ত্রের কথা প্রকাশ্যে আসে। সে সময় রুশ গণমাধ্যমের দাবি ছিল, পসাইডন প্রতি ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে এবং এটি এমনভাবে রুট পরিবর্তন করতে পারে যে তাকে আটকানো ‘অসম্ভব’।
এর আগে গত ২১ অক্টোবর ‘বুরেভেস্তনিক’ নামের নতুন এক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় রাশিয়া। দেশটির দাবি, এটি বিশ্বের যেকোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম। রাশিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী, ৯এম-৭৩০ বুরেভেস্তনিক (ন্যাটো নাম এসএসসি-এক্স-৯ স্কাইফল) হলো এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র, যাকে বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই আটকাতে পারবে না। পুতিনের ভাষায়, ‘এটি এক অনন্য অস্ত্র, যা আর কোনো দেশের কাছে নেই।’
তবে রাশিয়ার জন্য নতুন অস্ত্র পরীক্ষা করা বা সেগুলোকে প্রচার করা নতুন কিছু নয়। বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃতপক্ষে এসব অস্ত্রের সামরিক মূল্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাশিয়া-বিশেষজ্ঞ মার্ক গ্যালিওটি সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, এসব মূলত পৃথিবী ধ্বংসকারী ‘আর্মাগেডন অস্ত্র’। এসব অস্ত্র কেবল তখনই ব্যবহার করা যায়, যখন আপনি পুরো বিশ্বকে ধ্বংস করতে চাইবেন।’
প্রসঙ্গত, ‘আর্মাগেডন’ একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ ‘পৃথিবীর শেষ সময়ে একটি ভয়ংকর যুদ্ধ’। অর্থাৎ ‘আর্মাগেডন অস্ত্র’ বলতে সেই অস্ত্রগুলোকে বোঝায়, যার ব্যবহারে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
গ্যালিওটি জানান, পসাইডন ও বুরেভেস্তনিক দুটি এই ধরনের অস্ত্র। সেই সঙ্গে এগুলো ‘সেকেন্ড-স্ট্রাইক’ অস্ত্র, যা শুধু প্রতিশোধমূলক ব্যবহারের জন্য তৈরি। তবে এই অস্ত্রগুলো আদৌ কার্যকর কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ২০১৯ সালে একটি রকেট ইঞ্জিন বিস্ফোরণে পাঁচজন রুশ পারমাণবিক প্রকৌশলী মারা গিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, এই রকেট ইঞ্জিন বুরেভেস্তনিকের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) তথ্যমতে, এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পারমাণবিক প্রোপালশন ইউনিটের কর্মক্ষমতা নিয়ে নানান ধরনের ‘প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ’ আছে। আইআইএসএসের তথ্যমতে, এই জায়গায় রাশিয়ার এখনো ‘অনেক ঘাটতি’।
২০১৮ সালে পুতিন ‘অজেয়’ অস্ত্রের তালিকায় পসাইডন ও বুরেভেস্তনিকের নাম ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় সাত বছর পর, আবারও এসব অস্ত্র নিয়ে নতুন করে আলোচনায় পুতিন। প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন আবার এসব অস্ত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? এত দিন পর কি তবে রাশিয়া সফল হলো? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুটি অস্ত্র নিয়ে পুতিনের ঘোষণা যতটা না নতুন, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।
কয়েক মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংলাপের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এখন সেই কূটনৈতিক উদ্যোগ কার্যত ভেস্তে গেছে।
এরপর হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠক হঠাৎ বাতিল করে দিয়েছে হোয়াইট হাউস। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, মস্কো ও ওয়াশিংটনের অবস্থান এতটাই ভিন্ন যে এই বৈঠকে কোনো কার্যত কোনো ফল আসত না। এর পরপরই ট্রাম্প রাশিয়ার দুই বৃহৎ তেল কোম্পানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে পুতিন হয়তো ট্রাম্পের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই নতুন অস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন। রাশিয়া-বিশেষজ্ঞ মার্ক গ্যালিওটি বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতিশীল, আবার কখনো রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এমন দোলাচালে পুতিনের কাছে এই অস্ত্রগুলো দেখানো হলো শক্তির প্রদর্শন।’
এদিকে, ইউক্রেন আক্রমণের সাড়ে তিন বছরেও বড় কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি রুশ বাহিনী। বিপুল প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেও যুদ্ধ স্থবির।
ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেসের গোয়েন্দা প্রধান ডেভিড হিথকোট বিবিসিকে বলেন, ‘গ্রীষ্মকালীন যুদ্ধ মৌসুমের শেষের দিকে এসে রাশিয়ার পরিস্থিতি ভালো নয়। তাই এই ধরনের অস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণাকে তাদের প্রচলিত সেনাশক্তির দুর্বলতার প্রতিফলন হিসেবেই দেখা উচিত।’
তাঁর মতে, ‘রাশিয়া যখনই সংকটে পড়ে, তখনই অপ্রয়োজনীয় ও অতিরঞ্জিত সামরিক হুমকি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়।’
অবশ্য পুতিনের এমন হুমকিতে কাজ হয়েছে। ৩৩ বছর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেনাবাহিনীকে আবার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু অন্যরাও পরীক্ষা চালাচ্ছে, আমাদেরও করা উচিত।’ তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পরীক্ষা শুরু হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। আবার ট্রাম্প কী ধরনের অস্ত্র পরীক্ষার কথা বলেছেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত জানাননি।
ট্রাম্পের নির্দেশের পর ক্রেমলিন দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার এই পরীক্ষাগুলো ‘কোনোভাবেই পারমাণবিক পরীক্ষা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না’, বরং এগুলো ছিল পারমাণবিক ওয়্যারহেড বহনে সক্ষম ডেলিভারি সিস্টেমের পরীক্ষা।
তবে আইআইএসএসের কৌশল ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান ড. আলেকজান্ডার বোলফ্রাস বলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত সম্ভবত সরাসরি রাশিয়ার বুরেভেস্তনিক পরীক্ষার প্রতিক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রও এখন একই ধরনের আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) পরীক্ষার পরিকল্পনা করছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, মস্কোর ঘোষণা ট্রাম্পকে উসকে দিয়েছে। এদিকে, পুতিনের হুমকিতে ঘুম হারাম হয়ে গেছে ইউরোপের। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে তটস্থ ইউরোপ এখন এক নতুন সংকটে।
কিন্তু আসলেই কি পুতিনের রাশিয়া পসাইডন বা বুরভেস্তনিকের মতো বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে? নাকি পুতিন শুধু হুমকি দিয়েই পুরো বিশ্বকে জানান দিয়েছেন, ‘আমাদের এগুলো আছে, আমরা এটা করতে পারি’? সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক দর-কষাকষির প্রেক্ষাপটে মস্কোর সামরিক সক্ষমতা দেখানো একটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।




সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন