দক্ষিণ লেবাননের চারটি শহরে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। ইসরায়েল দাবি করেছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সামরিক স্থাপনা, তবে লেবাননের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- এই হামলায় বেসামরিক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্তত একজন নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দিনের শুরুতে এক ব্যক্তির মৃত্যু এবং বিকেলে আরও অন্তত একজন আহত হন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের আইতা আল-জাবাল, আল-তাইয়িবা, তাইর দেব্বা ও আব্বাসিয়াহ শহরগুলোয় হামলা চালানো হয়।
ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র আভিচায় আদরাই গতকাল বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করে জানায়, মানচিত্রে থাকা আইতা আল-জাবাল, আল-তাইয়িবা এবং তাইর দেব্বা গ্রামের ভবনগুলো চিহ্নিত করা হয়। এই তিনটি এলাকার মানুষকে একযোগে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। দক্ষিণের আরও দুটি শহরের জন্য একই নির্দেশ।

এই নির্দেশে বাসিন্দাদের চিহ্নিত স্থান থেকে অন্তত ৫০০ মিটার দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। লেবাননের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, দেশটির বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।
নির্দেশ জারির প্রায় এক ঘণ্টা পরই বিমান হামলা শুরু হয়। আকাশে ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে এবং শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরত্বে এবং প্রায় ২৪ কিলোমিটার উত্তর পর্যন্ত এলাকায় হামলা পরিচালিত হয়।
লেবানন সরকার ও হিজবুল্লাহ উভয়েই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আজকের হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরায়েল আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েল কোনো রাজনৈতিক সমাধানে আগ্রহ দেখায়নি এবং নিয়মিত হামলার মাধ্যমে তা প্রমাণ করছে।’
লেবাননের সেনাবাহিনীও এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘লেবাননের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং দক্ষিণে ধ্বংসযজ্ঞ আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে শত্রুর ধ্বংসাত্মক পদ্ধতির ধারাবাহিকতা এটি।’

হিজবুল্লাহ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে ইসরায়েলি হামলার মুখে ‘নীরব থাকা সম্ভব নয়।’
সংগঠনটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যে শত্রু আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে, আত্মরক্ষার জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের বৈধ অধিকার।’
হিজবুল্লাহ আরও জানায়, তারা সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করতে অস্বীকৃতি জানালেও লেবাননের সেনাবাহিনীর অভিযানে কোনো বাধা দেয়নি এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের ওপর কোনো গুলি চালায়নি।
ইসরায়েলি সরকারের মুখপাত্র শোশ বেদ্রোসিয়ান বলেন, ‘ইসরায়েল তার সমস্ত সীমান্ত রক্ষা অব্যাহত রাখবে, এবং আমরা লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর জোর দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে পুনর্গঠন করতে বা ২০২৩ ও ২০২৪ সালের স্থল ও বিমানযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত সামরিক শক্তি পুনরুদ্ধার করতে দেবে না।’
লেবাননে জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী (ইউএনআইফআইএল) বলেছে, ইসরায়েলি বিমান হামলা ২০০৬ সালে গৃহীত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ১৭০১-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা অবিলম্বে এই আক্রমণ এবং ১৭০১ নম্বর রেজোলিউশনের সব লঙ্ঘন বন্ধ করে। একইভাবে, আমরা লেবাননের পক্ষগুলোকেও এমন কোনো প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করতে পারে।
লেবাননের মন্ত্রিসভা বৃহস্পতিবার বৈঠকে সেনা কমান্ডার রোডলফে হাইকাল-এর কাছ থেকে দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর অস্ত্র ডিপো জব্দ অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে আপডেট শোনে।

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বছরের শেষ নাগাদ দক্ষিণ লেবানন থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা সব অস্ত্র সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে।
হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে লেবাননের দুই ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, তাদের সৈন্যরা নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় দ্রুত অগ্রগতি করছে।
গতকালব বৃহস্পতিবারের হামলায় দক্ষিণ লেবাননের আব্বাসিয়াহ শহরে একটি লোহার কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ব্যবসার মালিক আহমেদ আল-কাইয়াল বলেন, ‘এই দোকানটি পাঁচ-ছয়টি পরিবারের ভরণপোষণ করত। ভাই, একজন কামার কী করে? আল্লাহর দোহাই, সে তো শুধু চেয়ার, টেবিল, দরজা, জানালা, রেলিং বানায়। এটা কি যুদ্ধের লক্ষ্য হওয়া উচিত?’
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হলে, হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলে বিক্ষিপ্ত হামলা শুরু করে হিজবুল্লাহ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে এই সংঘাত পূর্ণমাত্রার ইসরায়েলি আগ্রাসনে রূপ নেয়। এতে ৪ হাজারের বেশি লেবানিজ নিহত এবং প্রায় ১৭ হাজার জন আহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিনই দক্ষিণ লেবাননে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে।
চুক্তির পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর ৩৫০ জনেরও বেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছে।
গতকালও হিজবুল্লাহর এলিট রেদওয়ান ফোর্সের এক কমান্ডারকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে ইসরায়েলকে দক্ষিণ লেবানন থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করার কথা ছিল। তবে তারা এখনো আংশিকভাবে সেনা উপস্থিতি বজায় রেখেছে, বিশেষ করে পাঁচটি সীমান্ত চৌকিতে।
সূত্র: আল-জাজিরা

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন