ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট, ২০২৫

বাংলাদেশি পর্যটক নেই

কাঁদছেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা, বছরে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা 

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ১১:৩৬ পিএম
কলকাতার ‘মিনি বাংলাদেশ’। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কলকাতার ‘মিনি বাংলাদেশ’ খ্যাত এলাকা। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ও মারকুইস স্ট্রিট ঘেরা এই এলাকা, নিউ মার্কেটের কাছাকাছির এই এলাকাটি এক সময় বাংলাদেশি পর্যটকদের প্রাণকেন্দ্র ছিল।

তবে গত এক বছরে বাংলাদেশি পর্যটকের আগমন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসায় এখানকার হোটেল, খাবারের দোকান, ট্রাভেল এজেন্সি, ফরেন এক্সচেঞ্জ ও খুচরা ব্যবসার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

সোমবার (৪ আগস্ট) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু এই এলাকাতেই ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর কারও কারও মতে, প্রকৃত ক্ষতি এর চেয়ে অনেক বেশি।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান বলেন, ‘হোটেল, রেস্তোরাঁ, খুচরা দোকান, ট্রাভেল এজেন্ট, মানি চেঞ্জার, চিকিৎসা সেবা ও পরিবহন মিলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার ব্যবসা হতো। এখন সেই প্রবাহ একেবারে থেমে গেছে। নিউ মার্কেট ও বড়বাজার-সহ আশপাশের এলাকার ক্ষতি হিসাব করলে মোট ক্ষতি ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।’

এই এলাকা বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় ছিল মূলত সাশ্রয়ী হোটেল, দেশি খাবারের রেস্তোরাঁ, প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা এবং প্রধান রেলস্টেশন ও বাস টার্মিনালের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে। এক সময় যেখানে রাস্তাজুড়ে গমগম করত পর্যটকদের ভিড়, এখন সেখানকার চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। দোকানপাট খোলা থাকলেও, বিক্রি নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশি পর্যটক না থাকায় ফাঁকা কলকাতার রাস্তা। ছবি- সংগৃহীত

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, পরিস্থিতি যতদিন বাংলাদেশে স্থিতিশীল না হবে, ততদিন এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।

মার্কুইস স্ট্রিটের এক ট্রাভেল কোম্পানির ম্যানেজার প্রবীর বিশ্বাস স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘এক বছর আগেও এই সময়টায় প্রতিদিন একাধিক বাসে বাংলাদেশি পর্যটক আসতেন। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করার জায়গা খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। আর এখন এমন অনেক দিন চলে যায়, যখন একজন পর্যটকও দেখা যায় না।’

এই ধস সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে খাবারের দোকান, মানি এক্সচেঞ্জ আর হোমস্টে ব্যবসায়। বাংলাদেশি টাকায় লেনদেন করা মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে।

মারকুইস স্ট্রিটের মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সচিব মোহাম্মদ ইন্তেজার বলেন, ‘আমরা টিকে থাকার জন্য হিমশিম খাচ্ছি। পুরোপুরি বাংলাদেশি পর্যটকদের উপরই নির্ভর করতাম’।

ব্যবসায়ীদের মতে, এই সংকট শুরুর পর থেকে এলাকার প্রায় ৪০ শতাংশ ছোট ও মাঝারি রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব বড় রেস্তোরাঁ এখনো চালু আছে, তারা সীমিত আয়োজনে চালাতে বাধ্য হচ্ছে।

রাধুনী রেস্তোরাঁর মালিক এনসি ভৌমিক বলেন, ‘ব্যবসা এখন মাত্র ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের বেশিরভাগের জন্য এটা অলাভজনক হয়ে পড়েছে। আমরা কেবল অপেক্ষা করছি, পরিস্থিতির বদলের আশায়।’

ঢাকা থেকে পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেন দ্বিতীয়বার ক্ষতির মুখে পড়েছে এই এলাকা। প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল কোভিড মহামারির সময় বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশি পর্যটক না থাকায় ফাঁকা কলকাতার রাস্তা। ছবি- সংগৃহীত

মার্কুইস স্ট্রিটের এক জনপ্রিয় খাবারের দোকানের মালিকের ছোট ভাই বলেন, ‘মহামারির পর আশাবাদী হয়ে অনেকেই ব্যবসায় নতুন করে বিনিয়োগ করেছিলেন, কেউ কেউ ঋণও নিয়েছিলেন। তখন ভাবিনি, পরিস্থিতি এভাবে আবার বদলে যাবে। আমার ভাই এখন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। প্রতি মাসে ১.৫ লাখ টাকা ইএমআই দিতে হচ্ছে, অথচ আয় প্রায় নেই বললেই চলে।’

এই বিপর্যয় শুধু বড় ব্যবসায়ীদের নয়, প্রভাব ফেলেছে পুরো অনানুষ্ঠানিক পর্যটন অর্থনীতির ওপরও। হোমস্টে পরিচালনা করা পরিবার, ট্যুর গাইড, হোটেল কর্মী, রাঁধুনি, গাড়ি চালক থেকে শুরু করে খুচরা দোকানের শত শত কর্মী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।

এলিয়ট রোডের বাসিন্দা ফারহান রসুল বলেন, ‘মহামারির পর চাহিদা বেড়েছিল। তখন আমি দুটি বাণিজ্যিক গাড়ি কিনেছিলাম। ব্যবসা ভালো চলছিল, অনেক সময় বুকিং রাখতে পারতাম না। এখন মাসে মাত্র পাঁচ-ছয়টা বুকিং পাই, তাও মূলত স্থানীয়দের কাছ থেকে, যারা খুব একটা ভাড়া দিতে চান না। অথচ গাড়ির ঋণের কিস্তি ঠিকই দিতে হচ্ছে।’