কয়েক দিন আগে ভারতের নির্বাচন কমিশন বিহার রাজ্যের হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। আগামী নভেম্বরে রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে মাসব্যাপী ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শেষ হয়। তবে বিরোধী দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে, এই প্রক্রিয়া তাড়াহুড়ো করে সম্পন্ন হয়েছে এবং বহু ভোটারের ভুল ছবি, এমনকি মৃত ব্যক্তিদের নাম খসড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি সোমবার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।
গত ২৫ জুন থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত চলা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর) প্রক্রিয়ায় কমিশনের দাবি অনুযায়ী কর্মকর্তারা রাজ্যের তালিকাভুক্ত ৭ কোটি ৮৯ লাখ ভোটারের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে তথ্য যাচাই করেন। কমিশন জানায়, সর্বশেষ এমন সংশোধন হয়েছিল ২০০৩ সালে এবং এবার হালনাগাদ করা জরুরি ছিল।
নতুন খসড়া তালিকায় নাম রয়েছে ৭ কোটি ২৪ লাখের, যা আগের চেয়ে ৬৫ লাখ কম। কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এর মধ্যে ২২ লাখ মৃত, ৭ লাখ একাধিকবার নিবন্ধিত এবং ৩৬ লাখ রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন। সংশোধনের সময়সীমা ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ইতোমধ্যেই ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে। দেশব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাইয়ের জন্য অনুরূপ পর্যালোচনা চালানো হবে।
বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, মুসলিম ভোটারদের, যারা চারটি সীমান্তবর্তী জেলায় জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ, তাদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশন ও বিজেপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিবিসিকে পাঠানো জবাবে কমিশন ২৪ জুনের এসআইআরসংক্রান্ত নির্দেশনা এবং ২৭ জুলাইয়ের প্রেস নোট শেয়ার করেছে, যেখানে বলা হয়েছে কোনো যোগ্য ভোটারকে পিছিয়ে রাখা হবে না। কমিশন আরও জানায়, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহল থেকে ছড়ানো ভুল তথ্য বা ভিত্তিহীন অভিযোগের দায়ভার কমিশন নেবে না।’
কমিশন এখনো বাদ দেওয়া ভোটারদের তালিকা প্রকাশ করেনি বা ধর্মীয় ভিত্তিতে কোনো বিভাজন দেয়নি, ফলে বিরোধীদের অভিযোগ যাচাই সম্ভব নয়। হিন্দুস্তান টাইমসের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিশানগঞ্জ জেলায় ভোটার বাদ পড়ার হার বেশি, তবে অন্যান্য মুসলিম-অধ্যুষিত আসনে তেমন নয়।
এ বিষয়ে সংসদে বারবার কার্যক্রম স্থগিত হয়েছে। বিরোধী সাংসদরা ‘মোদি হটাও’, ‘এসআইআর বাতিল করো’ ও ‘ভোট চুরি বন্ধ করো’ স্লোগান দিয়েছেন। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টও শুনানি শুরু করেছে, কারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা এডিআর সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এডিআরের জগদীপ ছোকার বিবিসিকে বলেন, ‘এটি বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে করা হয়েছে এবং যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি। মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন বলছে, প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ছিল।’ সংস্থাটি আদালতে যুক্তি দিয়েছে, এই উদ্যোগে বিহারের লাখো প্রকৃত ভোটার ভোটাধিকার হারাবেন, যারা দেশের দরিদ্রতম রাজ্যের একটি বড় অংশ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
তাদের অভিযোগ, এসআইআর-এ নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ওপর, যেখানে নিজের ও বাবা-মায়ের নথিপত্র স্বল্প সময়ে দেওয়া প্রয়োজন, যা লাখো দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিকের জন্য অসম্ভব।
খসড়া তালিকা প্রকাশের সময় বিবিসি পাটনা ও আশপাশের গ্রামে গিয়ে ভোটারদের মতামত নিয়েছে। মহাদলিতদের বসতি দানারা গ্রামে অধিকাংশ মানুষ উচ্চবর্ণের জমিতে কাজ করেন বা বেকার। ভাঙাচোরা বাড়িঘর, সরু গলিতে খোলা নর্দমা, আর মন্দিরের পাশে দুর্গন্ধযুক্ত জমাট পানি তাদের জীবনের অংশ। বেশির ভাগ বাসিন্দা এসআইআর সম্পর্কে কিছুই জানেন না, কর্মকর্তারা আদৌ এসেছিলেন কি না, তাও নিশ্চিত নন। কিন্তু তারা ভোটের মূল্য বোঝেন। ‘ভোট হারানো মানে বিপর্যয়, এতে আমরা আরও দরিদ্র হয়ে যাব,’ বলেন রেখা দেবী।
খারিকা গ্রামে অনেক পুরুষ জানিয়েছেন, তারা এসআইআর নিয়ে শুনেছেন, ফরম জমা দিয়েছেন এবং নতুন ছবি তুলতে ৩০০ রুপি খরচ করেছেন। কিন্তু খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কৃষক ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তরকেশ্বর সিং একে ‘বিশৃঙ্খলা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি পরিবারের তথ্য দেখিয়ে ভুল ছবি, ভুল নামের উদাহরণ দেন—একজন মৃত চাচাতো ভাইয়ের নামও তালিকায় রয়েছে, আবার অন্তত দুজনের নাম দুইবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘স্পষ্টতই কোনো যাচাই হয়নি। মৃতদের নাম, ডুপ্লিকেট, এমনকি যারা ফরমই পূরণ করেনি, তাদের নামও আছে। এই প্রক্রিয়া সরকারের সম্পদ ও কোটি কোটি রুপি অপচয় ছাড়া কিছু নয়,’ অভিযোগ করেন তরকেশ্বর সিং।