২০২৬ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের নবম শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিনা মূল্যের বই ছাপা কমছে ৯ কোটি। বই ছাপা কমায় এ খাতে ব্যয় কমছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
এদিকে গত বছর মাধ্যমিক স্তরে অতিরিক্ত চাহিদার ৬০ লাখ বই না ছাপানোয় সরকারের ২৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তারপরও অতিরিক্ত চাহিদার বই উৎপাদন ও বিতরণে মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা গেছে বলে সূত্রের দাবি। ইতিমধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
সূত্র মতে, যৌক্তিক কারণেই চলতি বছরের তুলনায় আগামী বছর বই ছাপা কমছে। ছাপা কমায় সরকারের খরচও কমছে। কিন্তু জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে পাঠানো বইয়ের চাহিদার হিসাব অতিরিক্ত দেখানো হলে খরচ বেড়ে গচ্চা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী বই ছাপা ও বিতরণ নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এনসিটিবি।
এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি এনসিটিবির নিয়োগ করা পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন এজেন্টকে (পিএলআই) বইয়ের মান পরীক্ষার সঙ্গে অতিরিক্ত চাহিদার বিষয়টিও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। বই উৎপাদন ও বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন বই বিতরণ নিশ্চিত করতে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সময় নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী।
তিনি বলেন, মূলত দেশের ৫৮৫টি পয়েন্ট থেকে বইয়ের চাহিদা নেওয়া হয়। পয়েন্টগুলোতে যারা চাহিদা দেন আমরা তাদেরকে বলেছি, চাহিদার তথ্য সর্বোচ্চভাবে সঠিক করতে হবে। আমরা এই চাহিদা বোর্ডের চাহিদার সঙ্গে ক্রসচেক করব। পাশপাশি বইয়ের গুণমান নিশ্চিত করতেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন বই দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য মোট বইয়ের চাহিদা ছিল ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫১ কপি। মোট বইয়ের মধ্যে প্রাথমিকের বই ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫০৪ কপি। আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বই ছিল ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি। পরবর্তীতে চাহিদা যাচাই-বাছাই করে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় ৩০ কোটি ৪০ লাখ কপি বই।
আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ৩০ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৭ কপি বই ছাপার প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। মোট বইয়ের মধ্যে প্রাথমিকের বই রয়েছে ৮ কোটি ৯৪ লাখ ২৫ হাজার ১৪২ কপি বই। আর মাধ্যমিক স্তরে বই রয়েছে ২১ কোটি ৫৮ লাখ ২৯ হাজার ৭০৫ কপি বই।
চলতি বছরের সঙ্গে আগামী শিক্ষাবর্ষের সম্ভাব্য বই ছাপার তুলনামূলক পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে আগামী শিক্ষাবর্ষে মোট বই ছাপা কমছে ৯ কোটি ৭ লাখ ৩২ হাজার ৬০৭ কপি। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে কমেছে ২৫ লাখ ২৯ হাজার ৩৬২ কপি। মাধ্যমিকে কমেছে সর্বোচ্চ ৮ কোটি ৮২ লাখ ৩ হাজার ২৪৫ কপি।
প্রতিবছর প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার অনুমিত ধারণা থাকলেও আগামী শিক্ষাবর্ষে এই স্তরে বই কমেছে ২৫ লাখ। সূত্রের ধারণা, শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের মতোই রয়েছে। আর কমে যাওয়া ২৫ লাখ বই হয়তো অতিরিক্ত চাহিদা ছিল।
অন্যদিকে আগের মতো মাধ্যমিক স্তরের নবম-দশম শ্রেণির বই একসঙ্গে হওয়ায় আগামী শিক্ষাবর্ষে দশম শ্রেণির প্রায় ৫ কোটির বেশি বই ছাপার প্রয়োজন হচ্ছে না। পাশাপাশি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির তিনটি বই অপশনাল (বিকল্প) হওয়ায় ছাপা কমছে। দশমের সব ও তিন শ্রেণিসহ (ষষ্ঠ-অষ্টম) মাধ্যমিকে কমে যাওয়া ৮ কোটি ৮২ লাখ ৩ হাজার ২৪৫ কপির মধ্যে প্রায় ৬০ লাখ বই প্রকৃত চাহিদার অতিরিক্ত রয়েছে। মাধ্যমিকে চাহিদার অতিরিক্ত বইয়ের মধ্যে বেশির ভাগই নবম-দশম শ্রেণির। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে চাহিদার অতিরিক্ত বইয়ের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে বলেই মনে করছে সূত্র।
অন্যদিকে আগামী শিক্ষাবর্ষে বই ছাপা কমায় খরচও কমছে সরকারের। গত বছর ৪০ কোটি বই ছাপা ও বিতরণের জন্য এনসিটিবির বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৮০০ কোটি টাকার মতো। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাইয়ে মাধ্যমিক স্তরে বইয়ের চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ কমে যায়। সাধারণ হিসাবে ১৮০০ কোটি টাকায় ৪০ কোটি বই তৈরি করতে হলে গড়ে প্রতি বইয়ের উৎপাদন ও বিতরণ খরচ পড়ে ৪৫ টাকা।
এ হিসাবে আগামী শিক্ষাবর্ষে ৯ কোটি কম উৎপাদনে ৩১ কোটি বইয়ের খরচ পড়বে প্রায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকা। এতে গতবারের তুলনায় খরচ কমবে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে এনসিটিবির প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বাজেট এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে গতবারের চেয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে বই কমছে। আনুমানিক ১৫০০ কোটি টাকার মতো লাগতে পারে।
এদিকে গত বছর মাধ্যমিক স্তরে অতিরিক্ত চাহিদার ৬০ লাখ বই না ছাপানোয় ২৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হলেও অতিরিক্ত বইয়ের জন্য খরচ ঠিকই হয়েছে বলে দাবি করেছে সূত্র। তবে এ বিষয়ে পরিসংখ্যান না থাকায় নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
সূত্রের দাবি, বইয়ের চাহিদা সঠিক না হওয়ার পেছনে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী। যেসব জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি, সেখানে বইয়ের অতিরিক্ত চাহিদা দেখানোর প্রবণতা বেশি। দেশের যেসব জেলা থেকে অতিরিক্ত চাহিদা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে সেগুলো হলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুর।
উদাহরণ দিয়ে সূত্র জানায়, গত বছর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে বইয়ের চাহিদা ছিল ৮৫ হাজার ৭৪০ কপি। অথচ শতভাগ হিসেবে তারা বিতরণ করেছে ৭৬ হাজার কপি। অবশিষ্ট রয়েছে ৯ হাজার কপি। চন্দনবাড়ি ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণির ৫৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য বই লাগে ৭৭০ কপি। তারা বিতরণ করেছে ৪৬২ কপি। অবশিষ্ট রয়েছে ৩০৮ কপি। এভাবে ৭ম শ্রেণিতে ৩২২, ৮ম শ্রেণিতে ১৬৮, ৯ম শ্রেণিতে ৬৩ ও ১০ম শ্রেণিতে ৫৪ কপি বই অবশিষ্ট রয়েছে। চাহিদার তথ্য সঠিক হলে অবশিষ্ট থাকা বই ছেপে সরকারের টাকা গচ্চা যেত না।
উপজেলায় সরবরাহ করা বইয়ের মান যাচাই করে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এনসিটিবির নিয়োগ করা ইন্সপেকশন এজেন্ট (পিএলআই)। এমন একটি ইন্সপেকশন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, পিএলআইয়ের কাজের সময় তারা দেখেছেন উপজেলা অফিসের রেজিস্ট্রার অনুযায়ী শতভাগ বই বিতরণ করা হয়েছে, কিন্তু তখনও তাদের গোডাউনে প্রচুর বই মজুদ ছিল। চাহিদার অতিরিক্ত বই সরবরাহের বিষয়টি তাদের কাজের কাজের দায়িত্বের মধ্যে ছিল না। তাই গোডাউনে প্রচুর বই থাকার বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেও সংশ্লিষ্টরা উত্তর দিকে আগ্রহী ছিল না।
নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর এন্ট্রিলেভেলে (প্রাক-প্রাথমিক) নতুন শিক্ষার্থী বাড়বে, অথচ আগামী শিক্ষাবর্ষে কমছে কেন প্রশ্নের উত্তরে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বলেন, অনেক যাচাই-বাছাই করে চাহিদা আনা হয়েছে। তাই বইয়ের সংখ্যা কমলেও শতভাগ শিক্ষার্থী বই পাবে।
২০২৬ শিক্ষাবর্ষে অতিরিক্ত চাহিদার জন্য অতিরিক্ত খরচ যাতে না হয় সে জন্য প্রথম থেকেই সতর্ক এনসিটিবি। এ ক্ষেত্রে চাহিদা সঠিক করতে প্রথাগত পদ্ধতির পাশাপাশি একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, বরাবরের মতো মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আনার পাশাপাশি এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও জেলা-উপজেলা থেকে বইয়ের চাহিদার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করা শিক্ষার্থীদের তথ্য শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে এনে ক্রস চেক করা হচ্ছে। পাশাপাশি গতবছরের বইয়ের চাহিদার সঙ্গে আগামী বছরের চাহিদারও ক্রস চেক করা হচ্ছে। চাহিদার তথ্য যাতে সঠিক হয়, সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
এনসিটিবির উৎপাদন ও বিতরণ শাখা থেকে আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য বই ছাপার যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিকের মোট বই ৮ কোটি ৯৪ লাখ ২৫ হাজার ১৪২ কপি বইয়ের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৬০ লাখ ৬৫ হাজার ৬৪৮ কপি; প্রাথমিকে (প্রথম থেকে পঞ্চম) ৮ কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার ৭৩২ কপি এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬২ কপি।
অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের ইবতেদায়ির শিক্ষার্থীদের (প্রথম থেকে পঞ্চম) জন্য ৩ কোটি ২৩ লাখ ৩৬ ৪৮৫ কপি বই; ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ৪ কোটি ৪৩ লাখ ৭২ হাজার ১৪৯ কপি; সপ্তম শ্রেণির জন্য ৪ কোটি ১৬ লাখ ৯৬ হাজার ৬১১ কপি; ৮ম শ্রেণির জন্য ৪০ কোটি ৩৮ লাখ ৯৫ কপি; ৯ম শ্রেণির জন্য ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৯ কপি ও দশম শ্রেণির জন্য ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৯৯৬ কপি বই উৎপাদন ও বিতরণের প্রস্তুতি চলছে।
আপনার মতামত লিখুন :