গাজা নিয়ন্ত্রণে হামাসকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বেশ কিছু সশস্ত্র গোত্র ও গোষ্ঠী। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামাসের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে গাজার অভ্যন্তরে নানা সশস্ত্র গোষ্ঠী ও স্থানীয় প্রভাবশালী গোত্র হামাসের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর হামাস ফের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘অস্থায়ীভাবে নিরাপত্তা রক্ষার অনুমোদন’ পাওয়ার পর গাজা উপত্যকায় কঠোর অভিযানে ডজনখানেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে। হামাসের এসব অভিযানে নাখোশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ এ ট্রাম্প লেখেন, ‘ হামাস যদি গাজায় মানুষ হত্যা অব্যাহত রাখে, যা চুক্তির মধ্যে ছিলো না। তবে হামাসকে হত্যা করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ থাকবে না। বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
নিচে গত দুই বছরে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোত্র ও গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হলো—
আবু শাবাব গোত্র
রাফাহ এলাকার ইয়াসের আবু শাবাব হামাসবিরোধী সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্রনেতা। তিনি দক্ষিণ গাজার সেই অংশে কার্যক্রম চালান, যা এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আবু শাবাবের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, তিনি আকর্ষণীয় বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শত শত যোদ্ধা নিয়োগ দিয়েছেন।
যুদ্ধবিরতির আগে, ২ জুলাই গাজা উপত্যকার প্রভাবশালী এই নেতাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিলো হামাসের পরিচালিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইয়াসির আবু শাবাবের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ এনে তাকে বিচার মুখোমুখি হতে বলা হয়েছে। হামাসের ‘বিপ্লবী আদালতের’ আদেশে বলা হয়েছে, আবু শাবাবের বিরুদ্ধে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে ‘জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের’ অভিযোগ। যার মধ্যে অন্যতম আবু শাবাব জাতিসংঘের ত্রাণবাহী ট্রাক লুট করেছেন।
হামাস অভিযোগ করেছে, আবু শাবাবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। এই গোষ্ঠী পাল্টা অভিযোগ করেছে যে হামাস শুধু সহিংসতা চালাচ্ছে এবং ভিন্নমত দমন করছে।
আবু শাবাবের গোত্র মূলত রাফাহর পূর্বাঞ্চলকেন্দ্রিক এক বেদুইন সম্প্রদায়। পুরো গোত্র তার কর্মকাণ্ডে একমত কি না, তা স্পষ্ট নয়। আবু শাবাবের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৪০০ বলে ধারণা করা হয়।
দোগমোশ গোত্র
গাজা উপত্যকার অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী গোত্র দোগমোশ। ঐতিহাসিকভাবে এ গোত্রের সদস্যরা ভালোভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। গোত্রনেতাদের মতে, ভূমি রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ তাদের সংস্কৃতিরই অংশ। তাদের সদস্যরা ফাতাহ ও হামাসসহ বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
মুমতাজ দোগমোশ এ গোত্রের প্রধান নেতাদের একজন। তিনি একসময় গাজা সিটিতে ‘পপুলার রেজিস্ট্যান্স কমিটি’র সশস্ত্র শাখার নেতৃত্ব দিতেন। পরবর্তীতে তিনি গঠন করেন ‘আর্মি অব ইসলাম’, যা আইএস বা ইসলামিক স্টেটের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এই সংগঠনটি ২০০৬ সালে হামাসের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতকে আটক করার ঘটনায় জড়িত ছিল। পরে বন্দি বিনিময়ে শালিতকে মুক্তি দেওয়া হয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকেই মুমতাজ দোগমোশের অবস্থান অজানা। অতীতে হামাসের সঙ্গে এ গোত্রের সংঘর্ষ হয়েছে, কারণ তারা নিরস্ত্র হতে অস্বীকার করেছিল এবং আর্মি অব ইসলাম এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে অপহরণ করেছিল।
যুদ্ধবিরতির পর গাজা সিটিতে রোববার ও সোমবার হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে দোগমোশ গোত্রের সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের বহু সদস্য নিহত হন। অভিযোগ রয়েছে, সংঘর্ষের সময় সালেহ আলজাফারাওয়ি নামের এক সাংবাদিককে হত্যা করে দোগমুশ গোত্রের লোকজন।২৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিক গাজা উপত্যকায় হামাস ও ইসরায়েলের যুদ্ধের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন।
আল-মাজায়দা গোত্র
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরকেন্দ্রিক বৃহৎ ও প্রভাবশালী এই গোত্রের সদস্যরাও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে হামাস এই এলাকায় অভিযান চালায়। তাদের দাবি, হামাস সদস্য হত্যার দায়ে অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতার করার জন্য ওই অভিযান চালানো হয়। এসময় বন্দুকযুদ্ধ শুরু হলে হামাস ও গোত্রের উভয় পক্ষেই কয়েকজন নিহত হন।
গোত্রের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো হামাসের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা আবু শাবাবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। বরং হামাসের বিরুদ্ধে তারা ‘টার্গেট কিলিংয়ের অজুহাত হিসেবে অভিযান চালানোর’ অভিযোগ করেছে। গোত্রনেতারা দাবি করেছেন, নিহত হামাস যোদ্ধাদের দেহ থেকে উদ্ধার করা এক নথি এর প্রমাণ দেয়।
তবে সোমবার গোত্রপ্রধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে গাজায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হামাসের ‘নিরাপত্তা অভিযান’-এর প্রতি সমর্থন ও সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এই গোত্রের সদস্যদের মধ্যে ফাতাহ ও হামাস—উভয় দলের সমর্থকই রয়েছে।
রামি হেলিস
হেলিস গোত্র গাজা সিটির অন্যতম বৃহৎ পরিবার, যাদের মূল কেন্দ্র শেজায়িয়া উপশহরে। কয়েক মাস আগে গোত্রের জ্যেষ্ঠ সদস্য রামি হেলিস ও একই এলাকার আহমেদ জুনদেয়া মিলে হামাসবিরোধী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠন করেন। তারা শেজায়িয়ার সেই অংশে সক্রিয়, যা এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সার্বিকভাবে, গাজার ভেতরে হামাসের নিয়ন্ত্রণ এখন একাধিক স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী ও গোত্রীয় শক্তির চাপে নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। যুদ্ধবিরতির পরও গাজার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এভাবে বাড়তে থাকলে, সেখানে হামাসের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
হামাসের জন্য ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ
গাজার অভ্যন্তরে এখন হামাসের শত্রু কেবল ইসরায়েল নয়, নিজেদের ভেতরকার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও। স্থানীয় গোত্রীয় শক্তি, ব্যক্তিগত সেনাদল ও পুরোনো সশস্ত্র সংগঠনগুলো হামাসের কর্তৃত্বে চিড় ধরাচ্ছে। যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকলে, হামাসের জন্য আবার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন