শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২৫, ১২:৪৮ এএম

২০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ৪০০ ঠিকাদার

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২৫, ১২:৪৮ এএম

২০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ৪০০ ঠিকাদার

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

সিলেটের গোপালগঞ্জের আতাহারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছর পরও ভবনটির ৩০ শতাংশ কাজ বাকি।

অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসই-এই (জেভি) শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) সিলেট অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে বরাদ্দের ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছে। কাজ থেকে অন্তত ৫০ লাখ টাকা বেশি বিল তুলে নিয়ে গেছে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লাপাত্তা আওয়ামী লীগপন্থি এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এই ভবন ছাড়াও সিলেট জেলার অন্তত ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কাজ শেষ না করেই গত ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদাররা।

সিলেটের মতো রাজধানীর দক্ষিণখানের হাজী বেলায়েত আলী হাইস্কুলে একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা, উত্তরা গার্লস স্কুলে ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে। শুধু সিলেট কিংবা ঢাকা নয়, সারা দেশের অন্তত ৭ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ২০০ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম বিল তুলে নিয়েছেন ৪ শতাধিক ঠিকাদার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ ঠিকাদার লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় ভবনগুলোর বাকি কাজ শেষ হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। 

এদিকে অগ্রিম বিল দিয়ে বিপাকে পড়েছেন ইইডির বিভিন্ন জেলার ও মেট্রোর প্রকৌশলীরাও। কীভাবে কাজ আদায় করবেন তা নিয়ে দিশাহারাও তারা। কোনো কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী পড়েছেন শাস্তির মুখেও। কোনো কোনো প্রকৌশলী নিজের পকেটের টাকা দিয়েও কাজ সম্পন্ন করছেন। আবার কোনো কোনো প্রকৌশলী অগ্রিম বিলের শাস্তির ভয়ে শিক্ষা ছুটির অজুহাতে চলে গেছেন দেশের বাইরেও। তবে সব মিলিয়ে কাজ আদায় করতে ইইডি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছুটেছেন জেলায় জেলায়। অনেক জায়গায় বিষয়টি ধাপাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন ইইডির প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির নেতারা।

সার্বিক বিষয়ে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।

ইইডি শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি কাজে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন করে বিল নিতে হয়। অর্থাৎ যতটুকু কাজ শেষ হয়েছে সেই পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সারা দেশের অধিকাংশ জেলায়ই এসব নিয়ম মানা হয় না। কাজ না করেই ইইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে অগ্রিম বিল তুলে নেন ঠিকাদাররা। এই অগ্রিম বিল নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিতে হয় ভাগ।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার জানান, ঠিকাদাররা চাইলেই কি অগ্রিম বিল তুলতে পারেন? অগ্রিম বিল তুলতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের ভাগ দিতে হয়। ঠিকাদার ও ইইডির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই অগ্রিম বিল তোলা হয়। অগ্রিম বিল প্রসঙ্গে ইডিডির প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে ঠিক কতটি ভবনের বিপরীতে কত টাকা অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। এই বিষয়ে প্রধান কার্যালয় থেকে কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে ইইডির সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্র এই প্রতিবেদকে জানিয়েছে, সিলেট জেলার ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের বিপরীতে প্রায় ১৬ কোটি টাকা দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকা মেট্রোতে ৫৭, কিশোরগঞ্জে ১২, নারায়ণগঞ্জ ১৬টিসহ ঢাকা বিভাগে অন্তত ১শ’টি; বরিশাল বিভাগে ৪০, নোয়াখালীতে ৩২, কুমিল্লাসহ চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩৩টি; রংপুর বিভাগে ৩৬টি, সিলেট বিভাগে অন্তত ১০০টিসহ সারা দেশে অন্তত সাত শতাধিক ভবনের কাজের বিনিময়ে ২শ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতি জেলায়ই অগ্রিম বিল রয়েছে বলে জানিয়েছে ইইডির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। 

দেশের ১০টি জেলার প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কাজ পাওয়া বেশির ভাগ ঠিকাদারই আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা দলটির অনুসারী। সরকার পতনের পর তারা বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এর মধ্যে অনেকে জেলহাজতে আবার কেউ কেউ দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন। যার ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোনো কোনো ঠিকাদারের আত্মীয়স্বজনকে ম্যানেজ করে কাজ উদ্ধার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বরিশালের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাজেটের অব্যবহৃত অর্থ জুনের মধ্যে খরচ করতে হয়। তাই ঠিকাদারদের কিছু অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আগস্টেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে পালাবে এটা কে জানত? জানলে কি আর অগ্রিম বিল দেওয়া হতো। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের এক জেলার প্রধান প্রকৌশলী বলেন, আমার জেলায় কিছু বিল অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো মোটামুটি রিকভারি করার চেষ্টা করছি। তবে একটি বড় কাজ নিয়ে আটকে গেছি। আওয়ামী লীগের ওই ঠিকাদার বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। তার ভাতিজাও ঠিকাদার। তাকে বলেছি কাজটি তুলে দেওয়ার জন্য। দেখি কী করে। 

তবে বেশ কয়েকটি জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বললে তারা অগ্রিম বিল দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি। কেউ কেউ স্বীকার করলেও এত টাকা বিল নয় বলে জানিয়েছেন। আবার কোনো কোনো জেলায় কাজ শুরু না করে ঠিকাদাররা লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় কাজগুলো বাতিল করা হয়েছে।  এদিকে বিগত ৫ বছরে সিলেটে যে নির্মাণকাজ হয়েছে তার অধিকাংশই নি¤œমানের বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি সম্প্রতি সিলেট জেলার নির্মাণাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে এসে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে বিগত পাঁচ বছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক সিলেট জেলায় বাস্তবায়িত/বাস্তবায়নাধীন এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো, পরিচালন বাজেটভুক্ত কর্মসূচি এবং মেরামত ও সংস্কার কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। দীর্ঘদিন আগে কার্যাদেশ প্রদান করা হলেও অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হলেও ফিনিশিং কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ওই স্থাপনাগুলো ব্যবহার উপযোগী হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

অগ্রিম বিল পরিশোধের সময় ইইডির সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন মো. নজরুল হাকিম। তিনি বলেন, এখনো তো কাজ শেষ হয়নি। কিছু অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সব রিকভার হয়ে গেছে।

ইইডির সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুল আরেফিন খান বলেন, আমি কয়েকদিন আগে যোগদান করেছি। এসব কাজ হয়েছে ২০২২-২৩ সালে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।

অন্যদিকে শিক্ষায় অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল পরিশোধের ঘটনায় শাস্তির আওতায় আসছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) দুই নির্বাহী প্রকৌশলী। তাদের একজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং একই উদ্দেশ্যে অন্যজনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনই অগ্রিম বিল দেওয়ার পর ‘শিক্ষা ছুটির’ নামে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন।

এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী সম্পা সাহাকে দেওয়া কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়েছে, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলার সার্বিক কার্যক্রম বাস্তব অগ্রগতির সঙ্গে আর্থিক ব্যয়ের গরমিল পরিলক্ষিত হওয়ায় পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব প্রদানের জন্য আপনাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে জবাব প্রদানের সময়সীমা বিগত ১০ ফেব্রুয়ারি অতিক্রান্ত হলেও আপনি জবাব প্রদান করেনি, যা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ২০১৮ মোতাবেক অসদাচরণের শামিল।’

কিশোরগঞ্জের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামকে দেওয়া কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়েছে, প্রধান কার্যালয়ের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী গত ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। ‘পরিদর্শনকালে উন্নয়ন কাজের বাস্তব অগ্রগতির সঙ্গে আর্থিক ব্যয়ের গরমিল পরিলক্ষিত হয়। যা গুরুতর আর্থিক অনিয়মের শামিল।’ 

নোটিশে বলা হয়, ‘এমতাবস্থায়, আর্থিক অনিয়মের কারণে কেন তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা মোতাবেক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার যথাযথ ব্যাখ্যা আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান প্রকৌশলী বরাবর দাখিল করা জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’ এই নোটিশে সাইফুল ইসলামের বর্তমান ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সম্পা সাহা যুক্তরাষ্ট্রে গমনের আগে ইইডি থেকে ‘অনাপত্তিপত্র’ নেননি বলে জানা গেছে।

সার্বিক বিষয়ে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!