মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৫, ০৫:৪৭ এএম

ভূমি নিয়ে সহিংসতার বলি বেশির ভাগ নারীই

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৫, ০৫:৪৭ এএম

কৃষিকাজ করছেন নারীরা। ছবি-সংগৃহীত

কৃষিকাজ করছেন নারীরা। ছবি-সংগৃহীত

দেশে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও ভূমির মালিকানায় তাদের অংশীদারিত্ব অত্যন্ত সীমিত। ভূমি শুধু আর্থিক বা বাসস্থানের বিষয় নয়, এটি ক্ষমতার প্রতীক, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার উৎস হিসেবে দেখা হয়। নারীদের ভূমি অধিকারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের অন্যতম উপাদান। দেশে প্রচলিত আইনে নারীরা যে সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকার রাখেন তা থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। 

বিশ্লেষকদের মতে, ভাইয়ের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য দেশের অধিকাংশ নারীই পিতার মৃত্যুর পর ভাইয়ের কাছে উত্তরাধিকার সম্পত্তির দাবিই করেন না। তবে নির্দিষ্ট সময় পর প্রাপ্য সম্পত্তির দাবি করলে তা পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। আবার যারা দাবি করেন, তাদের অনেকেই নিজের ভাই এবং তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অপমান, লাঞ্ছনা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হন। অর্থের টানের কারণে তুচ্ছ হয়ে যায় রক্তের বাঁধন। হারিয়ে যায় বোনের প্রতি ভাইয়ের চিরায়ত ভালোবাসা। 

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লষণ করে যে উপাত্ত পাওয়া যায় সেখানে দেখা যায়, সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষ আইনের চোখে সমান হলেও, অনেক নারী ভূমি মালিকানা বা দখলে যুক্ত হতে পারেন না। মুসলিম ব্যক্তিস্বত্ব আইনে এক মেয়ে ছেলে থেকে অর্ধেক পায়; বিধবা স্বামীর ভাগ থেকে ১-এর ৪ ভাগ অথবা ১-এর ৮ ভাগ পায়। এ ছাড়া সংখ্যালঘু (হিন্দু) কুমারী নারীদের সম্পত্তি উত্তরাধিকার জীবন্ত অবস্থায় প্রাপ্য নয়। এদিকে ৯৬ শতাংশ ভূমি কেনা-বেচা বা তালিকাভুক্তিতে নারীর নাম থাকে না।

গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ জমির প্রকৃত মালিকানা না পাওয়ার বঞ্চনার পাশাপাশি নারী জমিসংক্রান্ত যেকোনো সহিংসতার শিকারও হচ্ছেন। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রাণহানি, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, হামলা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, আহত মানুষের সংখ্যা এবং মামলার সংখ্যা আমাদের দেশে আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অহরহ সংঘটিত ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা নারীর নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলছে। ভূমিবিরোধের জেরে নারীরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের নিপীড়ন ও সহিংস নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশি।

দেশে জমিসংক্রান্ত সহিংসতা ও মানুষের নিরাপত্তার ওপর তার প্রভাবের চিত্র উঠে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) করা এক গবেষণা প্রতিবেদনেও। এতে দেখানো হয়, দেশে জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতা, প্রাণহানি, আহত মানুষের সংখ্যা ও মামলা বাড়ছে। দেশের প্রায় ৫০ লাখ পরিবার সরাসরি জমিসংক্রান্ত বিরোধের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার ভবিষ্যতে জমি নিয়ে বিরোধের আশঙ্কায় রয়েছে। আদালতে জমিসংক্রান্ত প্রায় ১৪ লাখ মামলা অমীমাংসিত। মামলা চালাতে গিয়ে পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়। মামলাগুলো মীমাংসা হতে কয়েক প্রজন্ম চলে যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ প্রকাশিত ‘জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ ২০১৮’ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শহরের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন গ্রামের নারীরা, আর তারা আক্রান্ত হচ্ছেন মানসিক রোগে। নির্যাতিত নারীদের মধ্যে মধ্যবয়সী নারীই বেশি। জীবনে অন্তত একবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দেশে এমন নারী ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি গ্রামে ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরে এ হার ২৫ দশমিক ৪।

ভূমি আইনের অজ্ঞতা ও জটিলতা প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জমি নিয়ে সহিংসতার জেরে বলি হচ্ছেন নারীরা। এর বিশেষ কিছু লক্ষণীয় দিক হলো আইন ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক। ইসলামি উত্তরাধিকার আইন বা পারিবারিক আইন নারীকে কিছু অংশ জমির মালিকানা দিলেও বাস্তবে ভাইদের, স্বামী পক্ষের বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধার মুখে নারী অনেক সময় সেই মালিকানা আদায় করতে পারেন না।

সামাজিক ও পারিবারিক মানসিকতায় অনেক পরিবারে ‘বোনকে জমি দেওয়ার দরকার নেই’ এই ধারণা প্রচলিত। নারীর সম্পত্তি দাবি করাকে ‘লোভ’ হিসেবে দেখা হয়। এ ছাড়া জমির দখল, সীমানা নির্ধারণ বা বণ্টনের বিরোধে নারী চরম সহিংসতার শিকার হন। কারণ তারা প্রথাগত পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত জমি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন। আইনি সহায়তার অভাবে অনেক নারী আদালতে যেতেও ভয় পান। মামলার খরচ, দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচার ব্যবস্থায় নারীদের প্রতি সহানুভূতির অভাবও তাদের নিরুৎসাহিত করে।

অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহ আরও বলেন, চলমান সমস্যা সমাধানের জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে আইন প্রয়োগে জোর; উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদকে নারী-সহায়ক নীতি অনুসরণ করতে হবে। আইনি সহায়তা প্রসার; লিগ্যাল এইড, ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন (সিএলই) এবং এনজিওগুলোর মাধ্যমে নারীকে সহায়তা দেওয়া দরকার। সচেতনতামূলক প্রচার; ধর্মীয়, সামাজিক ও জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহার করে নারী সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে জনমত তৈরি করা। 

নারী জমির মালিক হওয়া মানে শুধু সামাজিক ন্যায্যতা নয়, বরং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। ইসলামিক শরিয়া আইনের নব্য ইজতেহাদের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব যে, ইসলাম নারীদের পুরুষের সমান সম্পত্তি দিতে চাইলে ক্ষেত্রবিশেষ বাধা দেয়নি। বাংলাদেশে এই উদারনৈতিক চিন্তা ও চর্চার ঘাটতি আছে। অন্যান্য মুসলিম দেশে এ-সংক্রান্ত ইসলামিক আইনের সংস্কার হলেও বাংলাদেশে গোড়া ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিকতার কারণে এই সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। 

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমিনুর রশীদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জমি এবং জমির ওয়ারিশসংক্রান্ত যে জটিলতা বিদ্যমান তার জন্য ভূমি আইন আধুনিকীকরণ ও ডিজিটালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। জমির মালিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার ওয়ারিশদের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে অটোমেটিক পদ্ধতিতে জমি বণ্টন হলে জমি নিয়ে জটিলতা অনেকাংশে সমাধান সম্ভব হবে। মামলা বা বিরোধ যেমন কমে যাবে, একই সাথে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ সদস্যরা প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের অংশ তৎক্ষণাৎ বুঝে পাবেন।

তিনি বলেন, দেশের প্রচলিত প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, একটি পরিবারের অভিভাবকের (সম্পত্তির মালিক) মৃত্যুর পর অনেকেই সরস (ভালো) জমিটি দখলে নিতে চায়। এক্ষেত্রে পরিবারের এমন কিছু ব্যক্তি থাকেন যারা কোনোভাবেই আপসে যেতে রাজি হন না। সরস জমি নিজের দখলে নিয়ে নিরস (কম মূল্যের) জমি অন্যান্য শরিকদের দিতে চান। অনেক ক্ষেত্রে সরস-নিরস সব জমি একজন তার নিজের দখলে নিতে চায়। সেক্ষেত্রে ভাই-ভাই এবং ভাই-বোনদের ভেতর চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যা বেশির ভাগ সময়ই আইন-আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বাস্তবতা যেখানে এমন সেখানে পরিবারের নারী বা বোনদের প্র্যাপ্যতা নিয়ে বেশির ভাগ ভাই বা পরিবারের অন্য সদস্যরা উদাসীন থাকে। 

তিনি আরও বলেন, অনেকে তো একাই নানা কৌশল এবং বল প্রয়োগ করে পুরো সম্পত্তি দখলে নিতে চায়। তারা দেশের প্রচলিত ভূমি আইন বা আইন কোনোটার তোয়াক্কা করে না। 

তিনি আরও বলেন, জমির প্রাপ্যতার বিষয় আসলে প্রকৃত মালিকানার বিষয়টি অগ্রগণ্য। মালিক কে সে বিষয়ে জানতে হলে জরিপ-রেকর্ডের বিষয়ে জানতে হবে। ভূমি জরিপ থেকে রেজিস্ট্রি, জরিপ-রেকর্ড সার্বিক বিষয়ে সবার স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ এসব বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকায় নানাবিধ জটিলতা এবং হয়রানির শিকার হতে হয়। 
  
মো. মোমিনুর রশীদ আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারী বড় ধরনের শক্তি। বলা যায়, কৃষি ও শিল্প সব জায়গায় নারী এখন অর্থনৈতিক শক্তি। কৃষিতে পুরুষ শ্রমিকদের অবদান কমে যাচ্ছে। ওই স্থান দখল করছে নারীরা। কিন্তু জমির ওপর তাদের অধিকার নেই বললেই চলে। ভূমির ওপর তাদের অধিকার যদি না থাকে ভবিষ্যতে কৃষির উৎপাদন বাড়ানো কঠিন হবে। শিল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রেও তাই।

উল্লেখ্য, বর্তমানে নারী উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তি পায়, তার ওপর নিজের অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যতটুকু সম্পদ প্র্যাপ্য হয় তার খুব কমই ভোগ করতে পারেন তারা। সেই সম্পত্তি বিক্রি করতে চাইলে নারীকে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এ ছাড়া, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ব্যাংকঋণ পেতেও সম্যসা পোহাতে হচ্ছে।

Link copied!