গত ১৫ বছর আওয়ামী শাসনামলে সব বিষয়ে সরকারের সুরে কথা বলে গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টি (জাপা) শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই রয়েছে চরম চাপে। এর মধ্যে তিন সিনিয়র নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায় দলের অন্তর্কোন্দলের সে চাপ আরও বহুগুণে বেড়েছে। অব্যাহতি নিয়ে বর্তমানে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন দলটির তিন জ্যেষ্ঠ নেতা যথাক্রমে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হক (চুন্নু)। নেতৃত্ব নিয়ে দলের চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরোধে সপ্তমবারের মতো ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে জাপাতে।
এর আগে দলীয় সম্মেলন নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানের পর গত সোমবার জাপার মহাসচিব পদ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নিয়োগ দেন দলের চেয়ারম্যান। চুন্নুর মতো সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিনকেও সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যদিও জি এম কাদেরের এ সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন আনিস, হাওলাদার ও চুন্নু।
গত মঙ্গলবার গুলশানে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত বেআইনি। আমরা এখনো স্বপদে বহাল আছি। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। চেয়ারম্যানের প্রতিটি সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রকাশ।
আনিসুল ইসলাম আরও বলেন, জি এম কাদের রাতের অন্ধকারে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে জোর করে সিগনেচার নিয়েছিলেন। তখন এরশাদ সাহেব খুব অসুস্থ ছিলেন। গণতান্ত্রিক কোনো দলের কেউ রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নিন, কাউন্সিলে আমরা যেতে চাই। আপনি (জি এম কাদের) কেন সম্মেলন করতে চান না? কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অব্যাহতি পাওয়া মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা প্রমুখ।
এদিকে, মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মহাসচিব নিযুক্ত করায় আমি চেয়ারম্যানের কাছে কৃতজ্ঞ। তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মতামতে দলকে সাজাতে চাই এবং আমাদের হারানো নির্বাচনি আসন পুনরুদ্ধারে কাজ করতে চাই।
তিনি আরও বলেন, যে উপজেলা পদ্ধতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রবর্তন করেছিলেন, সেই উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পার্টিকে রিভাইব (পুনর্গঠন) করব। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একটা নতুন জাতীয় পার্টি গড়ে তুলে সুন্দর বাংলাদেশ গঠনে দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে যাব।
অপরদিকে, জাতীয় পার্টির দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মহাসচিব মো. মুজিবুল হককে (চুন্নু) বাদ দিয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব পদে নিয়োগকে চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেন। অব্যাহতি পাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তারা যৌথ বিবৃতিতে এই নিয়োগের বিরোধিতা করেন।
বিবৃতিতে এই দুই নেতা বলেন, এটি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ, যা পার্টির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তারা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুজিবুল হকই জাতীয় পার্টির বৈধ মহাসচিব। ঘোষিত কাউন্সিলের আগে চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে কোনো নিয়োগ বা বহিষ্কার কার্যকর নয়। মুজিবুল হককে কোনো কারণ ছাড়াই অব্যাহতি দিয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে একক সিদ্ধান্তে মহাসচিব নিয়োগ চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইতিমধ্যে জাতীয় কাউন্সিল ঘোষিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো প্রকার নিয়োগ, অব্যাহতি বা বহিষ্কার সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ। এই ধরনের সিদ্ধান্ত দলের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলছে। আমরা বিস্মিত যে, দায়িত্বশীল প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নিয়মিত চাঁদা প্রদান সত্ত্বেও মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যেভাবে অব্যাহতির চিঠি প্রদান করা হয়েছে, তা শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং নীতিহীন ও সম্মানহানিকর আচরণ।
আওয়ামী ঘনিষ্ঠ জাপার দুই পক্ষই: ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম ও মুজিবুল হক চুন্নু ২০০৬ সাল থেকেই জাপার আওয়ামীপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত। তারা দু’জনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার নির্বাচনে টানা চারবার এমপি হয়েছেন। ছিলেন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্যও। জি এম কাদের ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে এমপি হন। ছিলেন বিরোধীদলীয় উপনেতাও। ৭ জানুয়ারির ডামি ভোটখ্যাত নির্বাচনে অংশ নিয়ে হন বিরোধীদলীয় নেতা।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে বর্তমানে নিয়োগ পাওয়া ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী। ২০১৮ সালের মার্চে গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে নির্বাচন করে হেরে যান তিনি।
জাপা সূত্রে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনে জাপা চাপে পড়ায় পূর্ববর্তী ভূমিকার দায় এড়াতে নেতারা বিরোধে জড়িয়েছেন। ফ্যাসিবাদের দোসর তকমামুক্ত হতে জি এম কাদেরের পরিবর্তে জাপায় নতুন নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করছেন। জি এম কাদেরপন্থিরা তা প্রতিরোধে একাট্টা হয়েছেন। দলের ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামের ২৬ জন সদস্য জি এম কাদেরকে সমর্থন করছেন। তবে বিরোধীরা বলছেন, ২০ ধারার বলে জি এম কাদের সবাইকে জিম্মি করে রেখেছেন। নির্বাচনে শুধু আসন নয়, আর্থিক ফায়দাও তুলেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :