ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের দমাতে এবং সাধারণ মানুষের ওপর হওয়া দমন-পীড়নের তথ্য দেশ ও বহির্বিশ্ব থেকে গোপন রাখতে ইন্টারনেট বন্ধ করেন শেখ হাসিনা। তবে ‘ইন্টারনেট শাটডাউন’ করেও শেষ রক্ষা হয়নি স্বৈরাচারী শাসকের।
ইন্টারনেট খাতসংশ্লিষ্টরা এক বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, সঞ্চালন তার এবং ডাটা সেন্টারে আগুন লাগার নাটক সাজিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারই মূলত ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল। জানা যায়, ইন্টারনেট শাটডাউনে শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। ক্ষমতায় টিকে থাকতে দেশীয় ইন্টারনেট খাতের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি, বিদেশি গ্রাহকদের কাছে ফ্রিল্যান্সিং খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করে হলেও ইন্টারনেট বন্ধ করে হাসিনা-পলক প্রশাসন।
২০২৪ সালের ১৭ জুলাই সন্ধ্যা থেকে প্রথমে বন্ধ করা হয় মোবাইল ইন্টারনেট তথা ফোর-জি। টু-জি সেবা চালু থাকায় মুঠোফোনে কথা বলা এবং এসএমএস আদান-প্রদান করা গেলেও, মোবাইল ইন্টারনেট ছিল কার্যত বন্ধ। ১৮ জুলাই সকাল নাগাদ দেশজুড়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ইন্টারনেট।
টেলিযোগাযোগ খাতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর (এমএনও) নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পক্ষ থেকে নির্দেশনা দিয়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। তাৎক্ষণিক বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম হোয়াটস অ্যাপে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিল বিটিআরসি। অন্যদিকে ১৮ জুলাই সন্ধ্যা থেকে বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও। ফলে সেই সময় পুরো দেশ ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ইন্টারনেট কীভাবে বন্ধ করা হয়েছিল, সে বিষয়টি তুলে ধরেন দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আম্বার আইটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম। সে সময় তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অ্যাসোসিয়েশন অব দেশের (আইআইজিএবি) সভাপতি ছিলেন।
আমিনুল হাকিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সে সময় দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আসত রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) থেকে। বাকি ৬৫ শতাংশ ব্যান্ডউইথ আসত ছয়টি আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল) অপারেটর থেকে, যার একটি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) আবার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। এই ব্যান্ডউইথ আসে আইআইজিদের কাছে, যেখানে বিটিসিএলও একটি আইআইজি অপারেটর। আইআইজি অপারেটর থেকে ইন্টারনেট যায় আইএসপিদের (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) কাছে এবং সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত যায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যেমন আপনার-আমার কাছে। ফলে সরকার যদি শুধু নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই ইন্টারনেট সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ এমনিতেই থাকে না। সরকারের লোকজন সেগুলো বন্ধের পাশাপাশি সব আইটিসি এবং আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোর ডাটা সেন্টার বা ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে গিয়ে ফিজিক্যাল সুইচ বন্ধ করে দিয়েছিল। সুইচ বন্ধের পাশাপাশি আইআইজি এবং আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে।’
আমিনুল হাকিম আরও বলেন, ‘বিএসসিসিএল এবং আইটিসি থেকে ব্যান্ডউইথ বন্ধ করে দিলেই দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কোথাও যেন কোনো ব্যত্যয় না হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট ও ক্যাশ সার্ভার বন্ধে সব আইআইজি এবং আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।’
সরকারের এই অন্যায় নির্দেশনা না মানার কোনো পথ খোলা ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আমিনুল হাকিম বলেন, ‘খাতা-কলমে চিন্তা করলে হয়তো ছিল, কিন্তু বাস্তবে ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই যখন ব্যান্ডউইথ আসছে না, তখন আমরা সরকারের নির্দেশনা না মানলেই বা কী হতো? আর সবাই তো চায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে। কোনো ব্যবসায়ীই তো চায় না যে গোয়েন্দা সংস্থার লোক তার অফিসে এসে সুইচ বন্ধ করে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে তো অনুরোধের সুরে কোনো বার্তা আসেনি। তাদের কথা ছিল ইন্টারনেট বন্ধ করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প ছিল না।’
নিজেদের সিদ্ধান্তে ইন্টারনেট বন্ধ করলেও হাসিনা-পলক প্রশাসন সে সময় এর দায় চাপিয়েছিল অভ্যুত্থানকারীদের ওপর। রাজধানীর মহাখালীর খাজা টাওয়ারের ডাটা সেন্টার আর ইন্টারনেট সঞ্চালন লাইন আন্দোলনকারীরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার গল্প ছড়িয়েছিলেন পলক। সে সময় জুনাইদ আহমেদ পলকের বলা একটি কথা ‘আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে’, বেশ ভাইরাল হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় এ নিয়ে ব্যাপক ট্রল হয়েছিল।
ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে তৎকালীন সরকারের মিথ্যাচার নিয়ে আমিনুল হাকিম বলেন, ‘ইন্টারনেট সরকার নিজে থেকেই বন্ধ করেছিল। কিন্তু তারা বলেছিল ডাটা সেন্টারে আগুন লেগেছে। মহাখালীর যে খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হচ্ছিল, সেখানে তেমন কোনো ডাটা সেন্টার ছিলই না। বিটিসিএলের নিজের ডাটা সেন্টার মগবাজারে। আর আগুন লেগেছিল পাশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ভবনে। পুরোটা সময় ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে তৎকালীন সরকার মিথ্যাচার করেছে।’
১৮ জুলাই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইন্টারনেট সীমিত পরিসরে চালু হয় প্রায় সাত দিন পর। সে বছরের ২৪ জুলাই রাত থেকে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করে সরকার। তবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি ছিল অর্ধেকেরও কম। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করলেও, তখনো বন্ধ ছিল মোবাইল ইন্টারনেট। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালুর চার দিন পর ২৮ জুলাই বেলা ৩টা থেকে চালু হয় মোবাইল ইন্টারনেট। তবে বন্ধ রাখা হয় ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটস অ্যাপ, টেলিগ্রাম এবং টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন না মানার অভিযোগ আনা হয় এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরুদ্ধে। দেশের আইন মেনে কার্যক্রম পরিচালনায় জবাব চেয়ে পলকের নির্দেশে ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকের কাছে চিঠিও দিয়েছিল বিটিআরসি।
মূলত, আওয়ামী লীগের পছন্দমতো কার্যক্রম পরিচালনা না করাই ছিল সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর অন্যায়। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠির জবাব দিতে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল প্ল্যাটফর্মগুলোকে। সবশেষে ৩১ জুলাই চালু করা হয়েছিল ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটক। যদিও এই সময়গুলোয় ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের (ভিপিএন) মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করত আন্দোলনকারীরা।
রাজধানীর মিরপুর পল্লবী এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী কাশফিয়া শ্রাবন্তী শান্তা বলেন, ‘একপর্যায়ে ইন্টারনেট চালু হলেও সোশ্যাল মিডিয়াগুলো বন্ধ ছিল। কিন্তু আমরা (আন্দোলনকারীরা) নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতাম মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই। এর জন্য ভিপিএন ব্যবহার করতাম। আবার ভিপিএন ব্যবহারেও ভয় ছিল, কারণ পুলিশ মোবাইল ফোন চেক করে ভিপিএন অ্যাপ পেলে হয়রানি করত।’
নিজের চেয়ার টিকিয়ে রাখতে শেষ মুহূর্তেও ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল শেখ হাসিনা। ৪ আগস্ট দুপুর ২টা থেকে দ্বিতীয় দফায় মোবাইল ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে এত কিছুর পরেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কাছে হার মেনে ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।
আপনার মতামত লিখুন :