বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোহাম্মদ নাঈম মিজি

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৫, ০৯:০২ এএম

পুতিনের রহস্যময় ভূ-রাজনীতি ও ইউরোপের ব্যর্থতা 

মোহাম্মদ নাঈম মিজি

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৫, ০৯:০২ এএম

পুতিনের রহস্যময় ভূ-রাজনীতি ও ইউরোপের ব্যর্থতা 

সময় ১৯৯১। আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হয় সোভিয়েত রাশিয়ার পতন। এর কিছু পূর্বে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের ভাঙন প্রত্যক্ষ করার পর সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের সুর যার মনে গুঞ্জন তোলে তিনিই ১৯৯১ তে সাক্ষী হন সোভিয়েতের পতনের। যা তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে চিত্রায়িত করলেও যখন ‘কেজিবি’র (কএই) ‘বিদেশি গোয়েন্দা শাখার’ সহকারী সিনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন তখন এই ভাঙনকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলেছেন। তা তো বটেই, ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব বাইপোলার থেকে ইউনিপোলারে রূপান্তর হয়। পরবর্তীতে কেজিবির কাজ ছেড়ে পুরোদমে সক্রিয় হন রাশিয়ার রাজনীতিতে, স্বপ্ন একটাই- যদিও এটাকে স্বপ্ন না বলে উচ্চাকাক্সক্ষা বলাই শ্রেয়- সোভিয়েত রাশিয়ার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার। তিনি প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন।

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এ রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালালে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউক্রেন তার এক-তৃতীয়াংশ সার্বভৌমত্ব হারায় কিন্তু পরবর্তীতে পাল্টা হামলা মাত্র ৯ শতাংশ অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারে কিয়েভ। শত শত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে উড়িয়ে পুতিন হাঁটছে তার নিজের পথে নিজের স্বার্থে। ১৬ হাজারের বেশি ইন্ডিভিডুয়ালস, ৯ হাজারের বেশি কোম্পানি, ৩ হাজারের বেশি ইনস্টিটিউশনাল স্যাংশনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হচ্ছে রাশিয়াকে। কিন্তু তাতে কি বেশ দাপটে অবস্থানেই আছে পুতিনের রাশিয়া। শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বোকা বানিয়ে আসছে। নিজের লক্ষ্য অর্জনের আগে ক্লান্ত হবেন না পুতিন। কিন্তু কি তার লক্ষ্য?  

বর্তমান রাশিয়ার পশ্চিম ও দক্ষিণের মোট ১৪টি রাষ্ট্র সোভিয়েতের গর্ভ থেকে এসেছে। ভৌগোলিক দিক বিচারে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার কাছে কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক দেশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-ভাগের নয় ভাগের এক অঞ্চল দখল করে থাকা রাশিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ বসবাস করে দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২৫ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে। বাদবাকি অঞ্চল বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনুপযোগী। তবে এখানে তা আলোচনার বিষয় না, রাশিয়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম সীমানা বাদে বাকি সীমানা সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও সর্বদাই অ্যান্টার্কটিকার বরফকূলে এসে হাজির।

যেখানের বরফের স্তর কেটে বাণিজ্য জাহাজ চালানোর চাইতে মানুষের বুক কাটা সহজ-কথাটা কেবল বোঝানোর খাতিরে রূপক অর্থে বলা। হাতেগোনা মাত্র তিনটি বন্দরের ওপর বেশি নির্ভর করছে মস্কো। যুদ্ধের সময় গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে বন্দর বা নৌ-রুট একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার প্রধান বন্দর। সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর ‘ওরেসান্ড প্রণালি’-এর মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। এটি কনটেইনার, সাধারণ পণ্যসম্ভার এবং বাল্ক পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসম্ভার পরিচালনা করার জন্য সুসজ্জিত। কিন্তু, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া বাল্টিক অঞ্চলের তিন দেশের- লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া ও এস্তোনিয়া, বন্দর ব্যবহারের সুযোগ হারায়। পরে ২০০৪ সালে এসব দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়। ভøাদিভোস্টক বন্দর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত, ভøাদিভোস্টক বন্দরটি সুদূর প্রাচ্যে রাশিয়ার প্রধান বন্দর এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। এটি কনটেইনার, অটোমোবাইল এবং বাল্ক পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসম্ভার পরিচালনা করে। নভোরোসিয়স্ক বন্দর কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত, নভোরোসিয়স্ক বন্দরটি রাশিয়ার বৃহত্তম বন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং ভূমধ্যসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। এটি তেল, শস্য এবং অন্যান্য বাল্ক পণ্যসহ বিস্তৃত পরিসরের পণ্য পরিবহন করে।

রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও নৌরুট হলেও এই নভোরোসিয়স্ক বন্দর কৃষ্ণসাগর। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলে কৃষ্ণসাগরে যেমন- নিজেদের একক আধিপত্য বিস্তারে ঝামেলা পোহাতে হতো তেমনি বিশ্ববাণিজ্য নিয়েও চিন্তায় দিন কাটাতে হতো মস্কোকে। বাণিজ্য একটা দেশের চালিকাশক্তি সেই বাণিজ্যই যদি থাকে শত্রুর আওতায়, তাহলে এটা অস্তিত্বের প্রশ্ন বটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মানচিত্র এটাই ইঙ্গিত করছে যে, মস্কো ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল হয়ে এগোচ্ছে এবং এই অঞ্চলের পূর্ণ দখল নিতে চাইছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয় আর এখন ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল হয়ে এগোচ্ছে অর্থাৎ পুরো কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী অঞ্চল পুতিনের দখল চাই। হয়তো বা সম্পূর্ণ ইউক্রেনকে ল্যান্ডলক করে দিতে চাইছে। তবে এটা পুতিন যুদ্ধবিরতি শর্তে দাবি করেছে যে, ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ ও নিরস্ত্র রাষ্ট্রের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। এক কথায় বাফার ইস্টেট। ইউক্রেন কোনো এল্যাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না এবং কোনো ভারী সামরিক সরঞ্জামের অধিকারী হতে পারবে না।

গত শুক্রবারে ঘটে যাওয়া ট্রাম্প-পুতিনের আলাস্কায় শীর্ষ সম্মেলন ছিলও এক কথায় ইউরোপের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব ও ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব বিষয়ক। কিন্তু, এই সম্মেলনে যেভাবে ইউরোপ ও ইউক্রেনকে অবজ্ঞা করা হয়েছে তা এক প্রকার ইউরোপের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই না। সম্মেলনের সময়টুকু ছিলও ইউরোপের জন্য ‘ঐতিহাসিক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত’তা বললে তেমন ভুল হবে না। কারণ ট্রাম্প সম্মেলনের শুরুর আগ থেকেই বলে আসছে- একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য ইউক্রেনকে হয়তো কিছু অঞ্চল ছাড়তে হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পূর্বেই পুতিন এমন দাবি করেন যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে। অর্থাৎ রাশিয়া যেসব অঞ্চল দখল করেছে লুহানস্ক, দোনেতস্ক, ঝাপোরজিয়া ও খেরসনের যেসব অঞ্চল রাশিয়ার দখলের বাহিরে আছে সেসব অঞ্চল রাশিয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিতে হবে এবং তা রাশিয়ার অঞ্চল হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দিতে হবে।

যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে যে, এসব অঞ্চল দখল করার মাধ্যমে কৃষ্ণসাগরে নিজেদের কর্তৃত্ব বাড়াতে পারবে পাশাপাশি বাণিজ্যিক রুট নিরাপদ করতে পারবে। একই সঙ্গে এই অঞ্চলগুলো রাশিয়ার জন্য ইউরোপের গেট বা প্রবেশদ্বারও বটে। ক্রিমিয়া এবং দনবাস বরাবরই রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সোভিয়েত আমল থেকে।  ইউক্রেন যদি এসব অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তাহলে এটা গোটা ইউরোপের জন্য এক বিরাট ভূ-রাজনৈতিক পরাজয় ও ব্যর্থতা। কারণ গত তিন বছরে ইইউ ইউক্রেনে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি বা তেমন চেষ্টাও করেনি। যে যুক্তরাষ্ট্রের সুরে সুর মিলিয়ে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সেই যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে বাদ দিয়ে পুতিনের সঙ্গে সম্মেলন করেছে। এটা ইউরোপের গালে এক চরম চপেটাঘাত। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভূ-রাজনৈতিক পরাজয় কারণ রাশিয়ার মেরুদ- ভেঙে দেওয়ার অভিযানে নেমে শেষে পুতিনকে নিজের দেশে আমন্ত্রণ করে আনে যুদ্ধবিরতি ঘটানোর জন্য।

তবে পুতিন আলাস্কা সামিটে সেসব দাবি করেছে কিয়েভ ও ইইউ মেনে নেওয়ার উপর নির্ভর করছে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে কি-না! যদিও ইইউ এর সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই কারণ যারা ৩ বছরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারে না এখন যে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না তাও স্পষ্ট। কার্যত ইউরোপ ও কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্রের কাঁধে ভর করে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

গত তিন বছরের নাটকীয়তা শেষে এটাই স্পষ্ট, কিয়েভ, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রে চরম পরাজয় হয়েছে এই যুদ্ধে তা ঢাকার জন্য কোনো পর্দা নেই ইউরোপের সামনে। আলাস্কা সামিটে ৫টি শর্ত জানিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে প্রেসিডেন্ট পুতিন। চোখ কপালে উঠার মতো বিষয় হলেও, সামিটের পূর্বে ধারণা ছিল পুতিন যেসব শর্ত দেবে তার মধ্যে বিশেষ আলোচনায় থাকবে মস্কোর ওপর থেকে সকল প্রকার অর্থনৈতিক স্যাংশন তুলে নিতে হবে। কিন্তু, এমন কোনো দাবি তোলেনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। আলাস্কা সামিট শেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বেশ ফলপ্রসূ ও বিরাট অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে স্বীকার করেন যে, কিয়েভের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ।

গত সোমবার ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠকের আগে জেলেনস্কি ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একাই নিজের জাতির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো সাহসিকতা প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দেখাতে পারেননি। বরাবরই ইউরোপের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার নজির আছে। ইউরোপ যে এই যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে তার আরেকটা প্রমাণের দেখা মিলে সোমবারের হোয়াইট সম্মেলনে যেখানে জেলেনস্কি বলেন, কোনো অঞ্চল বিনিময় হবে না। তবে ইউরোপ জোটের সাহায্যে কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনবে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হিসেবে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে ঘটতে যাওয়া ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে স্বাগত জানায়। ট্রাম্প স্পষ্টভাষী প্রেসিডেন্ট যার ফলে বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ইউরোপ তার নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করতে নারাজ। যা কিয়েভকে এক অনিশ্চিত ও বিভীষিকাময় ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করছে। 

মোহাম্মদ নাঈম মিজি
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!