এগারো শতকের ঘটনা। দ্য টেল অব গেঞ্জি নামে একটি বই লিখেছিলেন মুরাসাকি শিকিবু। ৫৪ অধ্যায়ে লেখা জাপানি লেখিকার এই বইকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম উপন্যাস। এক হাজার বছর পর আজও সেই উপন্যাস মুগ্ধ হয়ে পড়ছেন পাঠক। মুঠোফোন বা ডিজিটাল স্ক্রিনে সব যখন দেখা যায়, হাতের নাগালে যখন লোভনীয় সব সিরিজ আর সিনেমা, তখনো কেন সেকেলে ভাষা ও ভঙ্গিতে লেখা হাজার বছরের পুরোনো এই উপন্যাস পড়ছে মানুষ? বই পড়ে মানুষ আসলে কী পায়? জ্ঞান, আনন্দ আর তৃপ্তি তো পায়ই; পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যেরই উপকার হয় বিস্তর। শৈশব থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দেয় সারা জীবনের গভীর ভিত্তি। বই পড়ার অভ্যাসে আক্ষরিক অর্থে মন পরিবর্তন হয়। এমআরআই স্ক্যানার ব্যবহার করে গবেষকেরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পড়লে অনুরণিত হয় মস্তিষ্কের নিউরন।
পড়ার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউরন নেটওয়ার্ক শক্তিশালী ও পরিশীলিত হয়। ২০১৩ সালের এক গবেষণা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনকে ব্যস্ত রাখার উপায় হিসেবে বই ও ম্যাগাজিন পড়ার পরামর্শ দিয়েছে। গবেষণার চূড়ান্ত প্রমাণ এখনো হাতে না এলেও আভাস মিলেছে, বই পড়ার অভ্যাস থাকলে আলঝেইমারের মতো রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হয়ে যায়। বয়স্ক যাঁরা প্রতিদিন সুডোকু বা গণিতের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান, তাঁদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঠিক থাকে, উন্নত হয়। তাই আপনি যত আগে পড়া শুরু করবেন, আপনার জন্য তত ভালো। গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা কথাসাহিত্য পড়েন, গল্পে থাকা বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ জীবনের খোঁজ রাখেনÑ অন্যদের অনুভূতি ও আবেগ তাঁরা বেশি বোঝেন। গবেষকেরা এই ক্ষমতাকে ‘থিওরি অব মাইন্ড’ (মনতত্ত্ব) বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে শখের বশে পড়ার অভ্যাস কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। গত দুই দশকে এই হার প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, এমনই তথ্য উঠে এসেছে নতুন এক গবেষণায়। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকদের চালানো এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ‘২০০৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ বা পড়াশোনার বাইরে নিছক আনন্দের জন্য প্রতিদিন বই বা অন্যান্য কিছু পড়ার হার বছরে প্রায় ৩ শতাংশ করে কমেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৪ সালে এই হার ছিল সর্বোচ্চ, ২৮ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালে তা কমে মাত্র ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’ আমেরিকান ‘টাইম ইউজ সার্ভে’-তে অংশগ্রহণকারী ২ লাখ ৩৬ হাজারেরও বেশি মার্কিন নাগরিকের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে।
গবেষণাটি বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল ‘আইসায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এই সমীক্ষায় ‘পড়া’ বলতে শুধু বই পড়াকেই বোঝানো হয়নি; ছাপা বা ডিজিটাল মাধ্যমে ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, এমনকি অডিও সংস্করণও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পতনকে ‘গভীর উদ্বেগের বিষয়’ বলে অভিহিত করে গবেষণাটির সহ-লেখক জিল সোনকে বলেন, ‘সৃজনশীলতা বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য পড়ার অভ্যাস সব সময়ই একটি সহজ ও কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। যখন আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষার এমন একটি সহজ হাতিয়ার হারিয়ে ফেলি, তখন তা নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের ক্ষতি।’ সমীক্ষায় দেখা গেছে, যদিও সব গোষ্ঠীর মধ্যেই পাঠাভ্যাস কমেছে, তবে কয়েকটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে এই হ্রাসের হার অনেক বেশি। এর মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, স্বল্প আয়ের বা কম শিক্ষিত মানুষ এবং গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারা।
তবে আনন্দের জন্য বই পড়ার অভ্যাস এখনো পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি। তবে গবেষণায় একটি বিপরীত চিত্রও উঠে এসেছে। দেখা গেছে, যারা এখনো আনন্দের জন্য পড়েন, তারা বরং আগের চেয়ে আরও বেশি সময় ধরেই পড়ছেন। এ ছাড়া, সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বই পড়ার অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসেনি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিল সোনকে বলেন, ‘আমাদের ডিজিটাল সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে এর একটি বড় কারণ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন