নদী মানে জীবন। নদী মানে মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর অর্থনীতির শিরা-উপশিরা বয়ে চলা প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বহু নদী আজ মৃত্যুপথযাত্রী। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বুকচিরে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদীর কিছু অংশও এর ব্যতিক্রম নয়। এক সময়ের উত্তাল ঢেউ, নৌকা আর মাছের মেলা যেখানে ছিল, আজ সেখানে শুধুই স্থবিরতা, মৃতপ্রায় স্রোত আর অবৈধ দখলদারদের দাপট।
সুবর্ণচরের মানুষের জীবনযাত্রা এক সময় মেঘনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। মাছ ধরা, কৃষিকাজ, যাতায়াত; সবই নির্ভর করত এই নদীর উপর। নদীর পাড়ে ছিল শত শত নৌকা, জেলে পল্লির কোলাহল, আর জালের সঙ্গে ধরা পড়া জীবনের স্বপ্ন। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া থেকে যাত্রী ও মালামালবাহী ট্রলার, সী ট্রাক এসে ভিড়ত সুবর্ণচরের ভূঁইয়ার হাট নামক স্থানে। আবার এই ঘাট থেকেই যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করে ফিরে যেত হাতিয়ায়। এভাবেই চলছিল সুবর্ণচরের মেঘনা অববাহিকায় সাধারণ মানুষের জীবন। তবে সময়ের স্রোতে সেই চিত্র বদলাতে শুরু করে, নদীর পেটে জমে ওঠে বালু, বহমান মেঘনা ক্রমেই সরে যেতে থাকে দক্ষিণে। দক্ষিণে সরে গিয়ে সেটা বর্তমান চেয়ারম্যান ঘাটে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে নতুন করে। মাঝখানে সুবর্ণচর এবং হাতিয়ার মাঝে রেখে যায় মৃতপ্রায় মেঘনার স্মৃতিচিহ্ন। যেটি বর্তমানে মেঘনা লেক বা মেঘনা মরা নদী বলে পরিচিত। ইতোমধ্যে মৃতপ্রায় এই নদীটিকে স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর ‘মেঘনা অভয়াশ্রম’ হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে যে কোনো ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে।
প্রকৃতির অপরূপ খেয়ালে সৃষ্ট মেঘনা লেকটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার নিদর্শন। একসময় এই মেঘনার শাখা নদীটির পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্ত দুটি সরাসরি মেঘনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে নিয়ম করে এখানে জোয়ার এবং ভাটার নিয়মিত দৃশ্য বিরাজমান ছিল।
কিন্তু কালের প্রবাহে সে কথা এখন রূপ কথায় পরিণত হয়েছে। দখল দূষণে মেঘনার এই শাখা নদীটি এখন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহমান নদীটির পূর্বপ্রান্তে বাঁধ দিয়ে এটির প্রবাহমান ধারায় বাঁধা তৈরি করে এটিকে সুকৌশলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে প্রভাবশালী একটি মহল। মাছের ঘের তৈরি করে দখলে নিয়েছে নিজেদের। এ ছাড়াও দুপাশে গড়ে উঠা জনবসতির মানুষেরা দুপাশ থেকে কৌশলে একটু একটু করে নিজেদের দখলে নিচ্ছে নদীটিকে।মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলেও দুপাশের মানুষ অবাধে মাছ ধরে নদীটি থেকে।
নদী দখলের গল্পটা এদেশে নতুন নয়। নোয়াখালীর এই অংশেও একের পর এক চর জেগেছে নদীর বুকে। সেই চর দখল করে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর, বাজার, খামার। প্রভাবশালী মহল ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই কাজে যুক্ত। প্রশাসনিক তৎপরতা থাকে ক্ষণস্থায়ী-ফলে নদীর মূল স্রোতধারা সঙ্কুচিত হয়ে যায়, আর ধীরে ধীরে নদীটি রূপ নেয় মৃতপ্রায় খালে।
দূষণও নদীর মৃত্যুর আরেকটি বড় কারণ। স্থানীয় বাজার, আবাসিক এলাকা ও ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা থেকে প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে আবর্জনা, প্লাস্টিক, রাসায়নিক বর্জ্য। প্রভাবশালী একটি মহল গোপনে চুরি করে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি তুলছে নদীটি থেকে। এতে নদীর পানির মান নেমে এসেছে ভয়াবহ পর্যায়ে। পানি এখন আর আগের মতো স্বচ্ছ বা প্রাণবন্ত নয়; বরং দূষিত পানিতে মরে যাচ্ছে মাছ, হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নদীর এই মৃত্যু শুধু প্রাকৃতিক ক্ষতিই নয়, মানুষের জীবনেও ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। এক সময় এই নদী থেকেই আসত মাছের সরবরাহ, যা স্থানীয় মানুষের পুষ্টি ও আয়ের প্রধান উৎস ছিল। এখন নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। তবে মাছ না থাকলেও এ নদীটিতে রয়েছে প্রচুর পানি।
বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সুবর্ণচরে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে চাষাবাদের ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির যে তীব্র সংকট তৈরি হয় সে তীব্র সংকট থেকে উত্তরণে সহায়ক হতে পারে মেঘনা লেক। শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদে ভূগর্বস্থ সুপেয় পানি ব্যবহার না করে ব্যবহার করা যেতে পারে মেঘনা লেকের লাখ লাখ কিউসেক পানি। তবে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
নদীর গতিধারা পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তন নদী কূলবর্তী মানুষের জীবনধারা। সুবর্ণচরের এ অংশটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কৃষির ক্ষেত্রেও পড়ছে প্রভাব। নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ফসলের সেচে সমস্যা হচ্ছে। বর্ষায় নদী উপচে হঠাৎ বন্যা, আর শুকনো মৌসুমে পানির তীব্র সংকট- এই দুই বিপরীত চাপে নাকাল হচ্ছেন সুবর্ণচরের কৃষকরা।
সুবর্ণচরের বৃদ্ধ মৎস্যজীবী লোকমান হোসেন আফসোস করে বলেন, এই মেঘনায় এক সময় নৌকা দিয়ে মাছ ধরতাম, সেই নদী এখন চেনাই যায় না। পানি তো কমেছে, সেই সঙ্গে মাছও নাই। নৌকা এখন হারিয়ে গেছে। মাছ ও নাই নৌকা ও নাই।’
স্থানীয় গৃহবধূ আমেনা বেগম বলেন, ‘আগে আমরা নদীর পানি আনতাম রান্নার কাজে। এখন সেই পানি এত দূষিত, ব্যবহারই করা যায় না।’
এমন অসংখ্য মানুষের জীবনের গল্পে ধরা পড়ে নদীর মৃত্যুর করুণ চিত্র।
নদী বাঁচানোর উপায় আসলে একেবারে জটিল নয়, তবে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সঠিক পরিকল্পনা।
প্রথমেই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে কঠোরভাবে। নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে। পূর্ব প্রান্তে দেওয়া বাঁধ অপসারণ করে সেখানে প্রয়োজনে স্লুইসগেট নির্মাণ করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে; বাজার, শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়ির বর্জ্য যেন সরাসরি নদীতে না ফেলা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বনায়ন ও তীর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে নদীর পাড় ভেঙে না যায় এবং নদীর নাব্য বজায় থাকে।
নদী পুনঃখননের মতো টেকসই প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে, যাতে মৃতপ্রায় নদীতে আবার প্রাণ ফিরে আসে।
নদী শুধু পানি নয়, নদীই জীবনের উৎস। নদীর মৃত্যু মানে মানুষের জীবনের এক অংশের মৃত্যু। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মেঘনা নদীর মৃতপ্রায় অংশ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়, আমরা কতটা অসচেতনভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছি। এখনো সময় আছে; যদি সবাই মিলে সচেতন হই, নদীকে তার স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নিই। নদীর স্রোত আর ঢেউয়ের শব্দে আবার মুখরিত হতে পারে সুবর্ণচর। এক সময়ের মতোই জেলেরা নামতে পারে নদীতে, নদীর তীরে ফিরে আসতে পারে জীবন আর জীবিকার কোলাহল। এই নদীতে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে সে পানি সেচের কাজে ব্যবহার করে দূর করা যাবে শুষ্ক মৌসুমে সুবর্ণচরের সুপেয় পানির তীব্র সংকট। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচে, সভ্যতা বাঁচে। সুবর্ণচরের মেঘনাকে আবার প্রাণবন্ত দেখতে, আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, এখনই।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন