- রাজসাক্ষী মামুনের জেরা শেষ, হাসিনার মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণ ৮ সেপ্টেম্বর
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, র্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এবং এই নির্দেশনাগুলো (গুম-হত্যার) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে আসত।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীর জেরা চলাকালে এ দাবি করেন মামুন।
অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও আইজিপি হিসেবে দেড় বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। নিজের সম্মতিতে এ দেড় বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হলেও দ্বিতীয়বার মেয়াদ বাড়ানোর সময় তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অন্য কাউকে আইজিপির দায়িত্ব দেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবকে নিজের অনাগ্রহের কথা জানালেও গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের কারণে আবারও তাকে আইজিপি করা হয়।
জেরার সময় আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, তদবির করে আপনি আইজিপি হিসেবে এক্সটেনশন নিয়েছেন। জবাবে মামুন এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। পাল্টা প্রশ্নে দ্বিতীয়বার মেয়াদ বাড়ানোর সময় আপত্তি জানিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি অবসরের পর দুই দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
জেরায় মামুন আরও জানান, ছাত্রজীবনে তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বাবা দীর্ঘদিন শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং ছোট ভাইও একই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ব্যারিস্টার আরমান আটক থাকার বিষয়টি তিনি আইজিপির দায়িত্ব গ্রহণের সময় জানানো হয় উল্লেখ করে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাকে তুলে আনা এবং গোপনে আটক রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের ছিল। বিষয়টি জানার পর আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন, ‘ঠিক আছে, রাখেন। পরে বলব।’ কিন্তু পরে আর কিছু তিনি জানাননি। এরপর আমি কয়েকবার বিষয়টি তুলেছিলাম, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা সময়ের কর্মকা- নিয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, র্যাব সদর দপ্তর পরিচালিত উত্তরাসহ র্যাব-১ এর কার্যালয়ের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র্যাবের ইউনিটের অধীনে আরও অনেক বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো, যা একটা কালচারে (সংস্কৃতি) পরিণত হয়েছিল। অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মতো কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপারেশন) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকেরা সমন্বয় করতেন।
আর র্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত এবং এই নির্দেশনাগুলো (গুম-হত্যার) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারেন বলে জবানবন্দি দেন সাবেক এই আইজিপি। আর এই নির্দেশনাগুলো চেইন অব কমান্ড (শৃঙ্খলা) ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপারেশন) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে ভোট কারচুপি ও অনিয়মের ঘটনায় অন্য কর্মকর্তাদের মতো তিনিও পদক পান। তবে পদকপ্রাপ্তির সুনির্দিষ্ট কারণ স্মরণ করতে পারেননি। এর আগে ও পরে আরও দুবার তিনি পদক পেয়েছিলেন বলে জানান।
এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন। তাকে জেরা করছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত তাকে জেরা করা হয়। রাজসাক্ষীকে আসামি পক্ষের জেরা শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন। এর আগে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্র্যাইব্যুনাল-১ এ এই মামলার ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করেন। এ সময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পরে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন