- ২০২৪ সালে বিশ্বে সর্বোচ্চসংখ্যক ১০ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী নিখোঁজ হয়েছে স্পেনে যাওয়ার পথে।
- ২০২৪ সালে ঢাকায় প্রতি মাসে ৪৯৮ নিখোঁজের জিডি
- গাজায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিখোঁজ
- মেক্সিকোয় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ
- ৫০ বছরে প্রায় ১৪ কোটি ২৬ লাখ নারী নিখোঁজ
- ২০২৪ সালে ১০ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী নিখোঁজ
২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট নিখোঁজ হন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহম্মেদ। ছুটিতে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। ধানমন্ডির স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন তিনি। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় জিডি করেন তার বাবা জামাল উদ্দীন। প্রায় আট বছর পেরিয়ে গেলেও ছেলেকে এখনো ফিরে পাননি তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে নিখোঁজ জিডির পরিসংখ্যান থাকলেও ঠিক কতজন নিখোঁজ ফিরে এসেছে, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। এর কারণ হিসেবে পুলিশ বলছে, নানা কারণে নিখোঁজের জিডি হয়। পরিবার থেকে নিখোঁজের জিডি করলেও অনেকে ফিরে আসার পর তারা পুলিশকে জানায় না। ফলে নিখোঁজ হওয়া ঠিক কতজন ফিরে আসছে, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া পুলিশের জন্য সম্ভব হয়ে ওঠে না।
নিখোঁজদের অনেকেই ফিরে এলেও সবাই যে ফিরেছে, তা নয়। দিন, মাস, বছর পার হয়ে গেলেও অনেকের খোঁজ এখনো মেলেনি। স্বজনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকা এসব পরিবার ভুগছে মানসিক অশান্তিতে। কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে, কেউ ছোট্ট শিশুকে। কেউ হারিয়েছে কৈশোর পেরোনো তরুণ কিংবা তরুণী, যাদের ছিল অনেক স্বপ্ন। প্রিয়জনকে হারিয়ে স্বজনদের দিন কাটছে উদ্বেগ, আশঙ্কায়।
তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে নিখোঁজ ও গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে ১১৯টি। এসব অভিযোগের মধ্যে ১০৮টি নথিভুক্ত করেছে সংস্থাটি। অভিযোগগুলোর মধ্যে নিখোঁজ ২৮ জন ফিরে এসেছে, ৩৪ জন বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি ৫৭ জন এখনো নিখোঁজ। তবে নিখোঁজের অধিকাংশ ঘটনারই কোনো অভিযোগ পায় না মানবাধিকার কমিশন। ২০২১ সালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২১ সালে সারা দেশে ১৬২টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সংস্থাটিতে অভিযোগ এসেছে মাত্র আটটি। ২০২২ সালে সারা দেশে ১৫৮টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে সংস্থাটিতে অভিযোগ এসেছে হাতে গোনা কয়েকটি।
শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বে প্রতিবছর নিখোঁজ হয় কয়েক লাখ মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পিপল বলছে, এসব ঘটনার বেশির ভাগের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র; বিশেষ করে মাদক পাচারকারীরা। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী চোরাচালান, মানব পাচার, প্রাকৃতিক সম্পদ চুরিÑ এমন আরও অনেক অপরাধী চক্র মানুষের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। সবচেয়ে ডাকসাইটে অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকা- সাধারণত হয় বিশ্বজোড়া। তারা খুবই সুসংগঠিত, আর তাদের কারবারও বেশ নিয়মতান্ত্রিক। তাদের চোখে পড়বে আমাদের চারপাশে, নিত্যদিনের জীবনে; কখনো কখনো তারা ঢুকে পড়ে সিস্টেমের একেবারে গভীরে; তাদের দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ সব সামাজিক সংগঠনে।
সাক্ষ্য আইন অনুসারে বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি সাত বছর নিখোঁজ থাকলে তাকে মৃত অনুমান করে হয়। ভারতেও সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী সাত বছর কেউ নিখোঁজ থাকলে তাকে মৃত ধরা হয়।
২০২২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের অধীনে থাকা বিভিন্ন থানায় প্রায় ৪৯৮টি নিখোঁজ বা হারিয়ে যাওয়ার সাধারণ ডায়েরি দায়ের করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে শিশু থেকে বৃদ্ধÑ সব বয়সের মানুষ ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ফিরে আসে না, কারণ পুলিশ এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রাখে না। রাজধানীর থানাগুলোতে প্রায় নিয়মিতই নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ঢাকার ৫০টি থানায় ৪ হাজার ৫২টি নিখোঁজের জিডি হয়। অর্থাৎ, প্রতি মাসে গড়ে ২৩৮টি এ-সংক্রান্ত ডায়েরি করা হয়। এর মধ্যে ডিএমপির রমনা বিভাগে ৩৭৪টি, তেজগাঁও বিভাগে ১৬২, গুলশান বিভাগে ৬৩২, ওয়ারী বিভাগে ৮৭৫,ি লালবাগ বিভাগে ৩২৪, উত্তরা বিভাগে ৭৪৪, মিরপুর বিভাগে ৯০, মতিঝিল বিভাগে ৮৫১টি।
এ তো গেল বাংলাদেশের কথা। তাহলে বিশ্বজুড়ে কী অবস্থা? সম্প্রতি রেডক্রস জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ জন নিখোঁজ হিসেবে রেজিস্টার্ড, যা পাঁচ বছরে প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি জানিয়েছে, এই বৃদ্ধির কারণ সংঘাত, ব্যাপক অভিবাসন এবং যুদ্ধের নিয়মের প্রতি সম্মানের অভাব।
রেডক্রসের মহাপরিচালক পিয়ের ক্রাহেনবুহল এক বিবৃতিতে বলেছেন, সুদান থেকে ইউক্রেন, সিরিয়া থেকে কলম্বিয়া পর্যন্ত ট্রেন্ডটি পরিষ্কার। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছে, কারণ যুদ্ধের পক্ষ এবং তাদের সমর্থকেরা মানুষের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। ২০২৪ সালের শেষের দিকে আইসিআরসির ফ্যামিলি লিংকস নেটওয়ার্কে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ জন নিখোঁজ হিসেবে রেজিস্টার্ড ছিল, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ক্রাহেনবুহল সতর্ক করে বলেছেন, এই সংখ্যা বরফের চূড়া মাত্র।
তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ বছরের পর বছর বা দশক ধরে তাদের প্রিয়জনদের থেকে আলাদা রয়েছে। নিখোঁজের এই ট্র্যাজেডি অস্বাভাবিক নয়। যদি এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, আটক ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং মৃতদের সঠিকভাবে তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া যায়, তাহলে অগণিত পরিবার এক জীবনের কষ্ট থেকে বাঁচতে পারবে। প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একটি নাম, যার অভাব একটি পরিবারে দারুণ ক্ষত তৈরি করে।
যখন সব জায়গায় দুর্নীতি প্রবলভাবে জেঁকে বসে, তখন সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কারণে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এসব মানুষ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান হয় না। জাতীয় বা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষকে তারা প্রায়ই চুপ করিয়ে রাখে অর্থের বিনিময়ে। আবার কখনো অপরাধী গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও ব্যাপ্তি এতই বড় হয়ে ওঠে যে, কোথাও অপরাধের কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। যেসব গুমের সঙ্গে কোনোভাবে রাষ্ট্র জড়িত; যেখানে কোনো মানুষকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে, গোপনে আটকে রেখেছে অথবা মেরে ফেলেছে এবং লাশটাকে লুকিয়ে ফেলেছে, তাদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এই অপরাধের ধরন অনেক রকম হতে পারে: একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, একসঙ্গে অনেক মানুষের গুম হয়ে যাওয়া, অথবা নির্দিষ্ট সময়ে পরস্পর সংযুক্ত একাধিক ঘটনা। অনেকে আবার নিখোঁজ হন নিজের ইচ্ছাতেও।
গাজায় নিখোঁজ ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ
ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে গাজা উপত্যকায় অন্তত ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে বলে জানিয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাম্প্রতিক গবেষণা। নিখোঁজদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু এবং গাজার সরকারি হিসাব থেকে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
ইসরায়েলি অধ্যাপক ইয়াকভ গার্বের নেতৃত্বে তৈরি এই গবেষণা প্রতিবেদন হার্ভার্ড ডেটাভার্সে চলতি মাসেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ আরব এবং মিডল ইস্ট মনিটর। গার্ব তার গবেষণায় তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ ও স্থানিক ম্যাপিং ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলা ও মানবিক সহায়তা বাধাগ্রস্ত করার ফলে গাজা অঞ্চলের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বর্তমানে গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৬১ হাজার মানুষ। তবে গার্বের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকৃত সংখ্যা এই হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
গবেষণায় জানানো হয়, যুদ্ধ শুরুর আগে গাজার জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ২২ লাখ ২৭ হাজার। বর্তমানে গাজা সিটি, মাওয়াসি ও মধ্য গাজাÑ এই তিন অঞ্চলে মোট ১৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে। অর্থাৎ, কমপক্ষে ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিখোঁজ, যাদের একটি বড় অংশ বাস্তুচ্যুত অথবা নিহত হয়ে থাকতে পারে।
মেক্সিকোয় ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ
মেক্সিকোয় ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় সব গুমের ঘটনাই ঘটেছে ২০০৭ সালের পর থেকে। ওই সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফেলিপে ক্যালদেরন মাদকবিরোধী লড়াই শুরু করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তিদের জোরপূর্বক মাদক চক্রের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে বা প্রতিরোধ করার কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে। যদিও গুমের ঘটনায় এসব মাদক চক্র ও সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীগুলো প্রধানত দায়ী, তবে নিরাপত্তা বাহিনীকেও এসব গুমের ঘটনায় দায়ী করা হচ্ছে। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে বিশ্বজুড়ে ১৪ কোটি নারী নিখোঁজ হয়েছেন এবং এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত। এই দেশগুলোতে যৌন নির্যাতনমূলক গর্ভপাতের কারণে নারী-পুরুষের অনুপাতে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে, যার ফলে অনেক নারী নিখোঁজ হয়েছেন।
পাঁচ দশকে বিশ্বে নিখোঁজ ১৪ কোটি ২৬ লাখ নারী
১৯৭০ সালে যেখানে প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ নারী নিখোঁজ ছিলেন, সেখানে ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৪ কোটি ২৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের একটি পুরোনো রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত ও চীন নিখোঁজ নারীর সংখ্যায় শীর্ষে ছিল, যেখানে ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারত থেকে প্রায় ৫ কোটি নারী নিখোঁজ হয়েছিল। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির একটি রিপোর্টে জানানো হয়েছে যে, গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়ে প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ জনে দাঁড়িয়েছে, যার মূল কারণ সংঘাত, ব্যাপক অভিবাসন এবং যুদ্ধের নিয়মের প্রতি সম্মানের অভাব।
স্পেনের পথে অভিবাসনপ্রত্যাশী নিখোঁজের সর্বোচ্চ রেকর্ড
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে এবং বিভিন্ন দেশের ঝুঁকিপূর্ণ সীমানা পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাত্রার সময় অসংখ্য মানুষ জীবন হারাচ্ছে, নিখোঁজও হচ্ছে বহু মানুষ। কঠোর আইন, জীবনের ঝুঁকি, অনিশ্চয়তাÑ এসব বিপত্তি জেনেও অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। ফলে এই যাত্রা যেন হয়ে উঠছে মৃত্যুফাঁদ। ২০২৪ সালেও বিশ্বে সর্বোচ্চসংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশী নিখোঁজ হয়েছে স্পেনে যাওয়ার পথে। ওই বছর ১০ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে স্পেনে পৌঁছাতে গিয়ে।