ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ট্রলিং ট্রলার যখন  সবার গলার কাঁটা

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫, ০২:৩৭ এএম
ট্রলার

ভোর ৫টার দিকে পটুয়াখালীর মহিপুর থানার খাপড়াভাঙ্গা নদীর ঘাট থেকে একে একে বেরিয়ে পড়ছে বেশ কিছু ট্রলার। জ¦লছে লাল, নীল, সবুজ রঙের বাতি। সাগরের বুকে রুপালি ইলিশের সন্ধানে বের হওয়া এসব মাছ ধরার ট্রলারের বাহারি নামÑ আল্লাহর দান, আল্লাহর রহমত, আল্লাহ ভরসা, মা-বাবার দোয়া, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি। কিন্তু তারা বহন করছে অবৈধ ফাইন জাল বা বেহুন্দি জাল। কয়েক দিন সাগর চষে এরা হত্যা করবে সমুদ্রের নানা প্রজাতির মাছের পোনা। এসব ট্রলিং ট্রলারের জেলেরা বিষয়টি জেনেও মাছের পোনা ধ্বংস করছেন। কারণ তারাও দাদনের ফাঁদে আটকা। মহাজন যে জাল ট্রলারে তুলে দেবেন, তারা সেই জাল দিয়েই মাছ শিকার করবেন। 

বৃদ্ধ জেলে আক্কাস উদ্দিন (ছদ্মনাম)। মাছ ধরায় দুই যুগের অভিজ্ঞতা তার। তিনি বলেন, ‘আগে লম্বা জাল লইয়্যা সাগরে যাইতাম, বড় বড় ইলিশ পাইতাম। আর এ্যাহন ট্রলিং জাল লইয়্যা সাগরে যাইয়্যা মাছের পোনা ধরি। প্রত্যেক ট্রিপে যে মাছ মারছিÑ কয়দিন পর সাগর থাকবে, পানি থাকবে, মাছ থাকবে না। উপায় নাই, তাই মালিকের মর্জিতে যাই।’

ট্রলিং ট্রলার নতুন নাম। মূলত আগের মাছ ধরা ট্রলারগুলোই। সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত মাছ ধরার ট্রলার। তাই কাগজে কলমে এগুলো বৈধ ট্রলার। কিন্তু এসব ট্রলারে এখন ফাইন জাল নামে অবৈধ জাল ব্যবহৃত হচ্ছে এবং জাল টানায় ব্যবহৃত হয় ইঞ্জিনচালিত উইঞ্চ। অর্থাৎ, বৈধ জালের মাছ ধরা ট্রলারগুলোই অবৈধ জালের ট্রলিংয়ে রূপান্তর করেছেন চালাক-মালিকেরা। এই জালের শেষ প্রান্তের জাল সূক্ষ্মতায় এতটাই পাতলা ও ঘন ফাঁসবিশিষ্ট, একবার মাছ ঢুকে পড়লে ফিরে আসার আর কোনো উপায় থাকে না। শুধু বড় মাছ নয়, ছোট মাছ, ডিমওয়ালা মাছ, হাঙর, ডলফিন, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সাপ, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবাল, প্রবাল, সাগরঘাস এমনকি সামুদ্রিক পোকামাকড় পর্যন্ত ধরা পড়ে একসঙ্গে। বৈধ ট্রলারের অনিয়মের খেলায় দিশেহারা সামুদ্রিক প্রাণী।

কুয়াকাটার জেলেপল্লির এক নবীন জেলে বলেন, ‘কীসের নিয়ম, এসব ট্রলার মালিক প্রতি বছর বিভিন্ন দপ্তরে লাখ লাখ টাকা দেয়। আর টাকা খরচ করলে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়! তা না হলে এই ট্রলারগুলো ঘাটে জাল নিয়ে আসে, প্রকাশ্যে জাল রোদে শুকায়, মেরামত করে। কই প্রশাসন তো একদিনও একটি জাল পুড়ল না!’

সম্প্রতি বরগুনা জেলোর পাথরঘাটা উপজেলায় ট্রলিং ট্রলারের জেলে, ব্যবসয়ীদের সঙ্গে কোস্ট গার্ড সদস্যের বড় আকারে ঝামেলা হয়। এ ঘটনার পর পর ট্রলিং ট্রলারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় কোস্ট গার্ড ও মৎস্য প্রশাসন। উপককূলের বিভিন্ন মৎস্য বন্দরে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করে প্রশাসন। কয়েকটি ট্রলার আটক করে মাছ ধরার সামাগ্রী খুলে ফেলা হয়েছে। মালিকেরাও স্বইচ্ছায় উইঞ্চসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি খুলে ফেলছেন। ইতিমধ্যে কিছু ট্রলিং ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে। তবে এই ট্রলারের মালিকেরা উচ্চ আদালতে গিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। একদিকে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, অন্যদিকে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে মালিকপক্ষ।  

ট্রলিং ট্রলার ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের ট্রলারে বৈধ কাগজপত্র বয়েছে। নিবন্ধিত কাগজে ১০ পিস বেহুন্দি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। তারা এসব ট্রলার দিয়ে ৪০ মিটারের কম গভীরতায় মাছ শিকার করেন না। তাদের দাবি, পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের কয়েক হাজার ট্রলিং ট্রলার বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করে। একই বঙ্গোপসাগরে বিদেশি ট্রলিং ট্রলার মাছ ধরছে আর দেশের জেলেরা ধরতে না পারলে লাভ কী? তারা আরও দাবি করেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ভারতীয় শত শত ট্রলিং ট্রলার মাছ ধরছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনী অভিযান চালিয়ে ভারতের কয়েকটি ট্রলার আটক করেছে। এ জন্য দেশের জেলেরা বাংলাদেশি সমুদ্রসীমার শেষ প্রান্ত থেকেও ৩০-৪০ কিলোমিটার ভেতরে থাকেন। কারণ সীমানার কাছাকাছি পেলে ভারতীয় নৌবাহিনী ধরে নিয়ে অনুপ্রবেশের তকমা দিয়ে জেলে পাঠাবে।

ট্রলার মাঝি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর ভয়ে আমরা আমাদের সমুদ্রসীমার অনেক ভেতরে জাল টানি। সীমানার কাছাকাছি পেলে তারা ধরে নিয়ে যেতে পারে। আর এই সুযোগে ভারতীয় শত শত ট্রলিং ট্রলার আমাদের সীমানায় ঢুকে জাল টানে। তিনি আরও বলেন, ভারতের ট্রলিং ট্রলার বন্ধ না হলে আমাদের ট্রলিং বন্ধ করলে কোনো লাভ হবে না।

ট্রলিং ট্রলার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১২০-১৩০ টি ট্রলিং ট্রলার আছে। কিন্তু পাশর্^বর্তী দেশে হাজার হাজার ট্রলিং ট্রলার সাগরে মাছ শিকার করে। তাই ট্রলিং ট্রলার বন্ধ করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। 

এদিকে ট্রলিং ট্রলার মাছ শিকার করার কারণে অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা আশানুরূপ মাছ পাচ্ছেন না। তাই তারা ট্রলিং বন্ধের দাবিতে ফুঁসে উঠেছেন। গত ২৭ জুলাই কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে দুই শতাধিক জেলে ও ট্রলার মালিক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। তাদের দাবি, ট্রলিং ট্রলারের ফাইন জাল বা বেহুন্দি জাল সমুদ্রের সব ধরনের মাছের পোনা ধ্বংস করছে। এ জন্য সমুদ্রে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ফলে তারা মাছ পাচ্ছেন না। দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রলিং ট্রলার বন্ধের জোর দাবি তাদের। 

ট্রলিংয়ের বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠস্বরে কথা বলছেন ট্রলার মালিক সেলিম ফকির, ‘ট্রলিং ট্রলারে মাছ যা শিকার করে, তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি। এ জালে যখন পোনা ধরে তখন জেলেরা তা ফেলে দেয়। এ ছাড়া এই ট্রলারে জাল টানতে গিয়ে অন্যান্য জেলের জাল ছিঁড়ে ফেলে। এক কথায়, এই ট্রলিং ট্রলার এখন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধ না করলে সমুদ্র ধ্বংস হয়ে যাবে।’ 

অপর এক ব্যবসায়ী পান্না মিয়া বলেন, ট্রলিং ট্রলার সমুদ্রের মাছ শেষ করে ফেলছে। এখন আর আমাদের লম্বা জাল, লাল জাল, ছান্দি জালের জেলেরা মাছ পাচ্ছেন না। দিনে দিনে লোকসান গুনতে গুনতে এখন ক্লান্ত। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন ট্রলার মালিক ব্যবসা ছেড়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পালিয়ে গেছেন। 

অপর এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ধীরে ধীর আমরা সাগরে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। সাগরে মাছ কমছে, আয় কমছে, ঋণ বাড়ছে।’ কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যানুযায়ী, এ উপজেলায় নিবন্ধিত ৮৫০টি ট্রলার আছে। তবে নাম ও নিবন্ধনবিহীন ট্রলারের হিসাব নেই এই অফিসে। নিবন্ধনবিহীন ট্রলারের সংখ্যাও বেশ বড়। এর মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ ট্রলারে অবৈধ জাল ব্যবহার করা হয়, যা প্রতি মৌসুমে শত শত টন মাছ ধ্বংস করে। এ ছাড়া ছোট মাছ, ডিমওয়ালা মাছ, হাঙর, শাপলাপাতা, ডলফিন, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সাপ, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবাল, প্রবাল, সাগরঘাস এমনকি সামুদ্রিক পোকামাকড় মেরে ফেলছে। ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। 

স্থানীয় সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব ট্রলার মালিকের একটি শক্তিশালী লবিং রয়েছে, যারা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেও চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম।  

কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির অন্যতম সদস্য এবং উপকূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক কে এম বাচ্চু বলেন, সমুদ্রে অবৈধ জালে আটকে বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ, ডলফিনও মারা যাচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত কুয়াকাটা সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ১০টি মৃত কচ্ছপ ও ১৮টি ডলফিন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে মারা যাওয়া কচ্ছপ ও ডলফিন তীরে আসতে আসতে পচে-গলে পানিতে মিশে যায়। এই সংখ্যা কত, তার হিসাব কারো কাছে নেই। তাদের ধারণা, এসব কচ্ছপ ও ডলফিন জালে পেঁচিয়ে মারা পড়ছে। 

সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশ ২০২০ অনুযায়ী, লাইসেন্সবিহীন ট্রলার শান্তিযোগ্য অপরাধ, অবৈধ জাল জব্দ করে ব্যবহারকারীদের ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত জেল এবং ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু চলতি বছর অভিযান চালিয়ে আটটি ট্রলারকে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়, পাঁচটি ট্রলার জব্দ করে মামলা দেওয়া হয়েছে এবং আট জেলেকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।  

বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের তথ্যানুযায়ী, অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ করায় কোস্টগার্ড মৎস্য আইন, ২০২০-এর ৭, ২৮, ৫১, ৫২ ধারা মোতাবেক চলতি বছরের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ৫৯টি অবৈধ আর্টিসনাল ট্রলিং বোট জব্দসহ ২৩ জন জেলেকে আটক করেছে। পাঁচটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়, স্থানীয় থানায় পাঁচটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের এবং সংশ্লিষ্ট বোট মালিকদের বিরুদ্ধে ৩১টি মামলা দায়ের করেছে।  

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট (বিএন) মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘অবৈধ ট্রলিং প্রতিরোধে কোস্ট গার্ড শুধু আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধ না থেকে স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, জেলে সম্প্রদায় ও বোট মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত কাজ করছে। কোস্ট গার্ডের সচেতনতামূলক প্রচারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাথরঘাটা এবং মহিপুরের ট্রলার মালিকেরা স্বেচ্ছায় ৭৮টি ট্রলিং ট্রলারের গিয়ার অপসারণ করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ভবিষ্যতেও অবৈধ আর্টিসনাল বোটের বিরুদ্ধে অভিযান এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, ‘ট্রলিং ট্রলার আমাদের সমুদ্রের সব প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস করছে, মাছের ডিম ও মাছের খাবার নষ্ট করছে। মাছের আবাসস্থল ও পরিবেশ শেষ করে দিচ্ছে। এ কারণে মাছের প্রজনন কমছে। ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ৪০ মিমির নিচের সব জাল অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও করতে হবে।  

এ প্রসঙ্গে কলাপাড়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘ট্রলিং ট্রলারে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় ট্রলারের মালিকদের নোটিশ দিয়েছি। এরই মধ্যে পাঁচটি ট্রলার জব্দ করে মামলা দেওয়া হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।  গভীর সমুদ্রে ট্রলারে প্রতিদিন আইন লঙ্ঘন করছে, হত্যা করছে জীববৈচিত্র্য। প্রশাসন কখনো দেখে না, কখনো দেখেও না দেখার ভান করে। অবৈধ জালের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু না হলে একদিন এই সাগর শুধু নোনা জলই দেবে, খাবার নয়।

সম্প্রতি পটুয়াখালী জেলার মহিপুরে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সুরক্ষাবিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুর রউফ বলেছেন, ‘সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশ, ২০২০ অনুযায়ী এসব ট্রলার ব্যবহার অবৈধ। তাই এগুলো বন্ধ করতে আমাদের অভিযান অব্যহত থাকবে। পাশাপাশি জেলেদের সচেতন করার কার্যক্রম চলবে।’