চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার লোহাগড় গ্রামে অবস্থিত লোহাগড় মঠ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে। লোহাগড় মঠ চাঁদপুরের একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক স্থান। ডাকাতিয়া নদীর তীরে থাকা এ মঠের অবস্থান একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা, অন্যদিকে জমিদারি আমলের স্থাপত্যশৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একসঙ্গে পেতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন লোহাগড় গ্রামে।
ইতিহাস ও নামকরণ:
জনশ্রুতি অনুযায়ী, লোহ ও গহড় নামের দুই জমিদার ভাই এই মঠ নির্মাণ করেছিলেন। তাদের নাম থেকেই এলাকাটির নাম হয় লোহাগড়। ধারণা করা হয়, মঠটি প্রায় ৪০০-৭০০ বছর আগে তৈরি। কেউ কেউ মনে করেন, এটি নদীপথে যাতায়াতকারীদের জন্য জমিদারবাড়ির অবস্থান বোঝাতে নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার অনেকের মতে, মঠগুলো জমিদারদের উপাসনালয় হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
স্থাপত্য ও বর্তমান অবস্থা:
বর্তমানে এখানে তিনটি মঠ এবং একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের চিহ্ন রয়েছে। স্থানীয়দের কথামতো, এখানে একসময় মঠের সংখ্যা ছিল পাঁচটি, তবে আজ মাত্র তিনটি মঠই অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে একটি মঠে সূক্ষ্ম কারুকাজ ও মিনার আকৃতির গম্বুজ দেখা যায়, যা এখনো দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মঠের ভেতরে চোরের প্রবেশ ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জমিদারি আমলের সমাপ্তির পরবর্তী সময়ে গুপ্তধনের খোঁজে অনেকে মঠে উঠে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে স্থানীয়দের দাবি। জমিদার পরিবারের রেখে যাওয়া স্থাপত্যশৈলী এখন দেশের পর্যটন ক্ষেত্রের সম্ভাবনাময় খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপজেলা প্রশাসন অচিরেই স্থানটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
লোককথা:
লোহাগড়ের জমিদারদের ঘিরে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। তাদের বিলাসিতা, জমিদারবাড়ির শানবাঁধানো ঘাট, কারুকার্যময় কেল্লা; এসবের কথা এখনো স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়। তবে এসবের বেশিরভাগই এখন কেবল গল্প হয়ে আছে; সরাসরি প্রমাণ আর পাওয়া যায় না। কথিত আছে, একবার এক বৃটিশ ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘কেমন জমিদার এরা! রাস্তাগুলো এত খারাপ। জমিদারের কর্মচারীরা এ কথা শুনে লোহ এবং গহড়কে জানায়। এ কথা শুনে তারা রাস্তাটি সিঁকি ও আধুলির মুদ্রা দিয়ে ভরিয়ে দেয়। লোকটি ফেরার পথে তা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তবে জমিদারের কর্মচারীরা তার ওপর অত্যাচার করে বলে শোনা যায়। কিন্তু সে রাস্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া আরও শোনা যায়, একবার নাকি তাদের মা আম-দুধ খেতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তারা মাকে আম-দুধ খাওয়ানোর জন্য বাজারের সব দুধ ও আম নিয়ে আসে। এনে মাকে নাইন্দায় চুবিয়ে আম-দুধ খেতে দেয়। ধারণা করা হয়, সেখানেই মায়ের মৃত্যু হয়।
ভ্রমণপথ:
ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়া যায় সড়ক, রেল বা নৌপথে। সদরঘাট থেকে নিয়মিত লঞ্চে চাঁদপুর পৌঁছে সেখান থেকে সিএনজি বা মোটরসাইকেলে ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা বাজার হয়ে সহজেই মঠে যাওয়া সম্ভব। ঢাকা থেকে দূরত্ব প্রায় ১১৭ কিলোমিটার। ভ্রমণের পথে চাঁদপুরের ইলিশ খাওয়ার সুযোগ ভ্রমণকারীদের কাছে বাড়তি আনন্দ যোগ করে।
ভ্রমণার্থীদের জন্য আকর্ষণ:
মঠ এলাকায় রয়েছে সবুজ ধানের খেত। নদীর পাশে অবস্থান হওয়ার কারণে শান্ত পরিবেশ এবং পাখির কলতানে ঘেরা থাকে সবসময়। সকালে ও বিকেলে শালিক, কবুতর, টিয়া পাখিসহ নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়। ভ্রমণকারীরা তাই এখানে এসে শুধু ইতিহাসের ছোঁয়াই পান না, প্রকৃতির সঙ্গেও কাটাতে পারেন কিছুটা নিরিবিলি সময়। এ ছাড়া ভ্রমণকারীরা এখানে এসে জমিদারি আমলের একটি অংশ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন এবং প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। যারা ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘেঁটে দেখতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য লোহাগড় মঠ হতে পারে একটি ভ্রমণযোগ্য গন্তব্য।