- পাহাড় কেটে ও পরিবেশ ধ্বংস করে নির্মিত হয় প্রকল্প
- মাটি বিক্রি ও বরাদ্দ থেকে লুটপাট করা হয় কোটি কোটি টাকা
- দলীয় লোকজন পেলেও প্রকৃত ভূমিহীনরা পায়নি ঘর
- বরাদ্দপ্রাপ্তরা কেউ বিক্রি করছেন ঘর, দেউ দিচ্ছেন ভাড়া
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখাতে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয় ‘হাজীগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্প’। উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের হাজীগাঁও এলাকার বেশ কয়েকটি উঁচু পাহাড় কেটে দুই দফায় নির্মাণ করা হয় ৩৩৬টি ঘর। বর্তমানে বেশিরভাগ ঘরেই ঝুলছে তালা। কারণ যারা ঘরগুলো বরাদ্দ পেয়েছেন তারা সেখানে থাকেন না। তবে বরাদ্দপ্রাপ্তদের কেউ কেউ ঘরগুলো প্রকৃত গৃহহীনদের কাছে ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে নিচ্ছেন। আবার অনেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রিও করে দিচ্ছেন।
জানা যায়, প্রকল্প চলাকালে পাহাড় কাটার মাটি বিক্রি ও প্রকল্পের বরাদ্দের লুটপাটের ৫ কোটি টাকা গেছে তৎকালীন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জামিরুল ইসলামের পকেটে। শেখ হাসিনার অতি আস্থাভাজন তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বশর মো. ফখরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ মদতে হাজীগাঁও এলাকার বেশ কয়েকটি বড় বড় পাহাড় কেটে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সারা দেশের সঙ্গে ঘটা করে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পও উদ্বোধন করেছিলেন। এ সময় প্রকল্প এলাকায় চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন উপজেলা প্রশাসন।
এদিকে এত ঘটা করে উদ্বোধন করার পরও আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রকৃত গৃহহীন-ভূমিহীনরা ঘর পাননি। তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠজনদের দেওয়া তালিকা থেকে ঘর বরাদ্দ দিয়েছিলেন তৎকালীন পিআইও জামিরুল ইসলাম। আবার যাদের ঘর দেওয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগেরই নিজস্ব জমি ও ঘর-বাড়ি রয়েছে। ফলে বর্তমানে ৩৩৬ ঘরের মধ্যে ১০০ ঘরেও লোকজন থাকে না। প্রকৃত গৃহহীনরা এখন তাদের কাছ থেকে প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে ভাড়ায় নিচ্ছেন। আবার অনেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রিও করে দিচ্ছেন। প্রকল্প এলাকা পরিণত হয়েছে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। বর্তমানে আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা মাদক কারবারি, ছিনতাইকারী ও চোরদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে আনোয়ারা উপজেলার হাজীগাঁও এলাকায় ‘হাজীগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্প’র আওতায় প্রথম দফায় ২১৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়। শুরুতে দুটি কক্ষ, বারান্দা ও একটি কিচেন কাম বাথরুমের একটি ঘরের বরাদ্ধ ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
উপজেলা প্রকল্প অফিস কোনো ধরনের ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়াই নিজেরাই এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস ও ভূমি অফিসকে প্রকল্পগুলো দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী ধাপে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে একই জায়গায় আরও ১১৭টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এগুলোর ঘরপ্রতি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। তবে, আশ্রয়ণের এসব ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নেয় সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তারা। নি¤œমানের ইট, বালু, সিমেন্ট, কাঠ, ঢেউটিন ব্যবহার করে বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বছর না যেতেই নির্মিত এসব ঘরের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল। খুলে পড়ছে পলেস্তারা। বিদ্যুৎ ও পানির লাইন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারায় বেশির ভাগ পাহাড় অধিগ্রহণ করে কারখানা স্থাপনের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাজীগাঁও এলকায় যে কয়টি পাহাড় অবশিষ্ট ছিল তা নিধন করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে নিজেদের পকেট ভারি করতেই তৎকালীন পিআইও জামিরুর ইসলাম এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। প্রকল্পের জন্য পাহাড় কাটা মাটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। বটতলী ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান এম এ মান্নান ও ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম শামীম মাটি কাটা ও বিক্রিতে সহযোগিতা করেছেন।
যারা ঘর পেয়েছেন তাদের অন্যত্র বাড়ি-ঘর আছে। শুধু ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশে তারা এসব ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। বর্তমানে যারা আছেন তারা বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে ঘরগুলো ভাড়া নিয়েছেন। আবার অনেকে একেবারে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
এমনই একটি ঘরের বাসিন্দা রুমা আকতার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমার ঘর না। আমার এক আত্মীয় চালিতাতলী এলাকার খায়রুন্নেছা ঘরটি পেয়েছেন। তাদের অন্য জায়গায় ঘর থাকাতে আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছেন।
পরুয়া পাড়া এলাকার তৈয়ব ও ভক্তিয়া পাড়া এলাকার বশরের (কাইয়ুম চেয়ারম্যানের ডান হাত) ঘরে গিয়ে দেখা যায়, তাদের ঘর তালাবদ্ধ। দেওয়ালে মোবাইল নম্বর লিখে ঘর ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।
ঘর ভাড়া নেওয়া জসিম উদ্দিন বলেন, আমার আগে এখানে ঘর ছিল। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেওয়া হবে বলে আমাদের উচ্ছেদ করেছিল। অনেককে টাকা নিয়ে ঘর দেওয়া হলেও আমাদের ঘর দেওয়া হয়নি। আমি এখন প্রতিমাসে এক হাজার টাকা দিয়ে ভাড়ায় থাকি। এ সময় তিনি ঘরগুলো প্রকৃত গৃহহীনদের দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান।
জুঁইদ-ী এলাকার বাসিন্দা আহমদ হোসেন বলেন, এখানকার ঘর অনেকে বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে কেউ বিষয়টি প্রকাশ করে না। আমাদের না বলার জন্য হুমকি দিয়ে রখেছেন। এখানের পরিবেশ ভালো নয়। খারাপ লোকেদের আড্ডাখানা হয়ে উঠেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) উমা খান কাফি বলেন, হাজীগাঁও আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরগুলো আমার আগের কর্মকর্তারা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। ওখানে কি হচ্ছে, না হচ্ছে- এগুলো এখন আমরা বলতে পারি না। এগুলো দেখবে এসিল্যান্ড ও ইউএনও অফিস।
ইউএনও তাহমিনা আকতার বলেন, যেসব উপকারভোগীরা ঘর পেয়েও সেখানে থাকে না তাদের কাছ থেকে ঘরগুলো ফেরত নেওয়া হবে। কোনো অবস্থাতেই আশ্রয়ণের ঘর বিক্রি বা ভাড়ায় লাগানো যাবে না। এ বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।