বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসান আরিফ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ০২:৫৯ এএম

জুলাই জাতীয় সনদের অঙ্গীকারে আসছে বড় পরিবর্তন

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ০২:৫৯ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই জাতীয় সনদকে এক নতুন মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আলোচনার পর যে চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করেছে, তাতে অঙ্গীকারনামা অংশে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। প্রাথমিক খসড়ায় থাকা কয়েকটি বিতর্কিত প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে কমিশন। একইসঙ্গে বাস্তবায়নের পদ্ধতি সনদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না এমন নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এ পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ, সাংবিধানিক জটিলতা এবং নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। ফলে কমিশন চূড়ান্ত সনদে কেবল সেইসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করছে যেগুলোয় পূর্ণ বা আংশিক ঐকমত্য হয়েছে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত থাকায় এটি আলাদা সুপারিশ আকারে সরকারকে জানানো হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে অধিকাংশে ঐকমত্য হলেও কিছু মৌলিক প্রস্তাবে এখনো মতবিরোধ রয়েছে। অঙ্গীকারনামার ভাষায় পরিবর্তন এনে কমিশন দেখাতে চাইছে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে সনদকে সর্বজনগ্রাহ্য করতে আগ্রহী।

তবে মূল প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বাস্তবায়নের পদ্ধতি কীভাবে নির্ধারিত হবে? সরকার কি সংসদের মাধ্যমে এগোবে, নাকি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের পথে হাঁটবে? আগামী সপ্তাহে কমিশনের সুপারিশ প্রকাশিত হলে এ প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এর সমাধান রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই হতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

রাজনৈতিক তাৎপর্য

জুলাই জাতীয় সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট করছে দেশের রাজনীতিতে নতুন সামাজিক চুক্তির প্রশ্নে এখনো গভীর মতপার্থক্য বিদ্যমান। বিএনপি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পক্ষে অনড় অবস্থান নিয়েছে। জামায়াত ও এনসিপি গণভোট ও গণপরিষদের পক্ষে, যা জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে কমিশন চাইছে সমঝোতার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য পথ বের করতে। ফলে দেখা যাচ্ছে, জুলাই সনদ একদিকে ঐকমত্যের প্রতীক হলেও, বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো রাজনৈতিক টানাপোড়েন বজায় রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব মীমাংসা না হলে সনদের বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অঙ্গীকারনামায় যে পরিবর্তন

প্রথম খসড়ায় আট দফা অঙ্গীকার ছিল। এর মধ্যে তিনটি দফা নিয়ে বিএনপিসহ একাধিক দল আপত্তি জানায়। 

দ্বিতীয় দফা: প্রথমে লেখা হয়েছিল‘সংবিধান বা আইনে যা-ই থাকুক, প্রাধান্য পাবে জুলাই সনদ।’ বিএনপি এটিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পরিপন্থি আখ্যা দিয়ে আপত্তি জানায়। সমঝোতার ভিত্তিতে এখন ভাষা পরিবর্তন করে বলা হচ্ছে যেসব সংস্কার বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে, সেখানে জুলাই সনদের সুপারিশকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

তৃতীয় দফা: খসড়ায় ছিল, সনদের ব্যাখ্যার দায়িত্ব থাকবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের হাতে। বিএনপিসহ আট দল এতে আপত্তি জানায়। তাদের যুক্তি ছিল, সংবিধানের ব্যাখ্যার দায়িত্ব ইতোমধ্যেই আদালতের হাতে, তাই সনদের জন্য আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। আলোচনার পর কমিশনও এই ধারা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

চতুর্থ দফা: প্রথমে লেখা ছিল, ‘সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।’

বিএনপি জানায়, এতে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। সংশোধিত প্রস্তাবে রাখা হচ্ছে সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলো আদালতে বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। ভবিষ্যতে আদালতে প্রশ্ন উঠলে স্বাক্ষরকারী দলগুলো সনদকে আইনি ও সাংবিধানিকভাবে রক্ষা করবে। এই পরিবর্তনগুলোয় কমিশনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার সরাসরি সংবিধানকে অতিক্রম না করে বরং সংবিধানের ভেতরেই সনদকে কার্যকর করার পথ খুঁজে বের করা।

বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে বিভক্তি

সনদ বাস্তবায়নের জন্য কমিশন শুরুতে ছয়টি বিকল্প প্রস্তাব রাখে গণভোট, গণপরিষদ, সংসদ, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশ। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি।

জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি গণভোটের দাবি জানায়। বিএনপি ও কয়েকটি দল সংসদ ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে সনদ বাস্তবায়ন মেনে নেয়নি। কিছু দল রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, বাস্তবায়ন পদ্ধতি সনদের ভেতরে থাকবে না। বরং বিকল্প প্রস্তাবগুলো আলাদা করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপারিশ আকারে দেওয়া হবে। সরকারই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবে কোন পথ অনুসরণ করা হবে।

চূড়ান্ত সনদের কাঠামো

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত সনদ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হতে পারে। 

প্রথম খণ্ড: প্রশাসনিক আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব এমন সংস্কার। 

দ্বিতীয় খণ্ড: সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজনীয় প্রস্তাব এবং যেগুলোয় মতপার্থক্য বা নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৭৩টিতে ঐকমত্য হয়েছে। বাকি ১১টি মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য হয়নি, এর মধ্যে ৯টিতে বিএনপির আপত্তি আছে।

বিএনপির তিন ধাপের রূপরেখা

বিএনপি লিখিতভাবে কমিশনকে জানিয়েছে, তারা সনদ বাস্তবায়ন তিন ধাপে চায়। আশু করণীয়: সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয় এমন প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ, বিধি প্রণয়ন বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দ্রুত কার্যকর করবে। 

মধ্যম মেয়াদি বাস্তবায়ন: সংবিধান-সংশ্লিষ্ট নয় কিন্তু তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়নযোগ্য নয় এমন প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করবে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংবিধান সংশোধন: নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সংসদ দায়িত্ব নেওয়ার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংবিধান-সংশ্লিষ্ট সংস্কার বাস্তবায়ন করবে।

বিএনপি স্পষ্টভাবে বলেছে, বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষমতা নেই। যদি এটি করা হয়, তবে সেটি হবে অসাংবিধানিক ‘ক্যু’।

জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান

জামায়াতে ইসলামী চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে সনদের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করা হোক। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে। এসব প্রস্তাব কমিশনের ভেতরে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা ও প্রস্তাব

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব প্রস্তাব নিয়ে গণভোট সম্ভব নয়। তবে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রশ্নে গণভোট প্রয়োজন। কারণ উচ্চকক্ষ গঠনে সবাই একমত হলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকট।

এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবগুলো বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যান্য প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ ও সরকারের নির্বাহী আদেশ যথেষ্ট বলে তারা মনে করেন।

কমিশনের পরবর্তী পদক্ষেপ

আগামী সপ্তাহে কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক করবে। এরপর চূড়ান্ত সনদ ও বাস্তবায়নের সুপারিশ একসঙ্গে রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছে পাঠানো হবে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘প্রতিটি দলের মতামত আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি। সব প্রস্তাবের আইনি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা চাই, জুলাই সনদ যেন ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতায় না পড়ে এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়।’

কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় কমিশন কার্যালয়ে গত সোমবার বৈঠক হয়েছে। সেখানে সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামতও বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর সার্বিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবার দলগুলোর সঙ্গে এক দিনেই বৈঠক শেষ করতে চায় কমিশন। তবে প্রয়োজনে একাধিক দিনে গড়াতে পারে বলে মনে করছে সূত্রটি।

রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই ধাপে সংলাপ করে। প্রথম ধাপে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করে। পরে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে ২৩ দিনব্যাপী সংলাপ করে কমিশন। দুই ধাপের সংলাপের ভিত্তিতে প্রথমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পটভূমি ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকারনামা উল্লেখ করে একটি খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে দেয় কমিশন। সেখানে দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাস্তবায়নের রূপরেখা কমিশনকে তৈরি করে দিতে। এরপর গত ১৬ আগস্ট জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া দলগুলোকে পাঠানো হয়। সেখানে পটভূমি, বাস্তবায়নে আট দফা অঙ্গীকারনামার সঙ্গে ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি সুপারিশ উল্লেখ করা হয়।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ২৮টি দল ও জোটের সঙ্গে একাধিকবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে কমিশন। এ ছাড়া সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে। সর্বশেষ বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদের সাংবিধানিক বিষয়গুলো বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন বিশেষজ্ঞরা। বাকিগুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে বলেন। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ ও বাস্তবায়নের রূপরেখা রাজনৈতিক দল ও সরকারকে দেবে কমিশন।

সূত্র জানায়, জুলাই সনদে ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে এবং ২১টি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ এবং ৯টি সরকারের নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নের কথা ভাবা হচ্ছে। 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!