গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার দুই বছর চলছে। সেখানে দুর্ভিক্ষের চরম শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের দুই বছর পূর্ণ হবে আগামী ৭ অক্টোবর। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েল এত বেশি প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে যে, গাজায় জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৬৪ হাজার ৭১৮ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও দেড় লাখের বেশি। খবর তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদমাধ্যম আনাদোলুর। খবরে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৪ হাজার ৭১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবরুদ্ধ গাজায় নতুন করে আরও পাঁচজন অনাহারে প্রাণ হারিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে যে, গত ২৪ ঘণ্টার রিপোর্টিং সময়ের মধ্যে, গাজার হাসপাতালে ৭২ জনের মৃতদেহ আনা হয়েছে। আরও ৩৫৬ জন আহত হয়েছে । মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এখনো বহু মৃতদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে আছে। উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছাতে না পারায় তাদের সরানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া, গত ২৪ ঘণ্টায় অপুষ্টি ও অনাহারে আরও পাঁচজন ফিলিস্তিনি মারা গেছে। তাদের মধ্যে একজন শিশু। এতে গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৪।
এদের মধ্যে ১৪১ জনই শিশু। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এর মধ্যে ১২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে জাতিসংঘ সমর্থিত ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন’ গত মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে গাজাকে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল ঘোষণা করার পর। মৃতদের মধ্যে ২৬ জন শিশু। চলতি বছরের ২ মার্চ থেকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গাজার সব সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ২৪ লাখ মানুষের এই উপত্যকা এখন দুর্ভিক্ষে নিপতিত। মার্চের ১৮ তারিখ থেকে ইসরায়েলি সেনারা আবারও গাজায় হামলা শুরু করে। এর পর থেকে তারা আরও ১২ হাজার ৯৮ জনকে হত্যা করেছে এবং আহত করেছে ৫১ হাজার ৪৬২ জনকে।
এতে জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তি ভেঙে যায়। গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গাজায় চালানো এই যুদ্ধের কারণে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও হয়েছে।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এক দিনে অন্তত ৭২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজা সিটিতেই নিহত হয়েছেন ৫৩ জন। প্রায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৬৪ হাজার ছাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে গাজা সিটি দখলে অভিযান জোরদার করে ইসরায়েল।
অভিযানে বিমান হামলার পাশাপাশি স্থল অভিযানও চালানো হচ্ছে। স্থল অভিযানের জন্য গাজা সিটি খালি করতে উড়োজাহাজ থেকে লিফলেট ফেলে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে বাসিন্দাদের বার্তা দিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এসব বার্তায় বলা হয়, ‘গাজা সিটিতে যারা উপস্থিত আছেন, পূর্বের ওল্ড সিটি এবং তুফা এলাকা থেকে শুরু করে পশ্চিমে সাগর এলাকা পর্যন্ত সব এলাকায় আইডিএফ হামাসকে পরাজিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গাজা সিটিতে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে অভিযান চালানো হবে, যেমনটি চালিয়ে এসেছে আইডিএফ। আপনাদের নিরাপত্তার জন্য অবিলম্বে শহর ছেড়ে চলে যান।’ ইসরায়েলের এমন বার্তার পর গত মঙ্গলবার থেকে দলে দলে মানুষ গাজা সিটি ছাড়তে শুরু করে। পায়ে হেঁটে, গাধার পিঠে কিংবা গাড়িতে চড়ে দক্ষিণের দিকে সরে যেতে দেখা গেছে অনেককে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ফিলিস্তিনের ছোট্ট একটি অবরুদ্ধ ভূখ-ে ইসরায়েলি হামলায় সন্তান হারিয়ে হাহাকার করছেন হাজার হাজার মা। প্রতি মুহূর্তে ‘হাতের মুঠোয় জীবন’ নিয়ে আতঙ্কে সময় পার করছেন ফিলিস্তিনি মায়েরা। অভুক্ত পেটে, স্বামী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন হারানোর অব্যক্ত কষ্ট বুকে নিয়ে ইসরায়েলের হামলার মাঝেই দিন পার করছেন অসহায় এই মায়েরা। গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি মায়েরা কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তা তাদের না দেখলে বোঝা দায়।
গাজার ২০ লাখের বেশি মানুষ এখন ক্ষুধা ও মৃত্যুর মুখোমুখি। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে গাজার মায়েরা এক অন্তহীন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছেন। তারা এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করছেন এবং তাদের জীবন রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। ইসরায়েলের কঠোর নীতির কারণে গাজা উপত্যকায় খুব সামান্য খাদ্যসামগ্রীই প্রবেশ করছে। গাজার মায়েরা মসলাযুক্ত উপাদেয় খাবারের পরিবর্তে কোনো রকম ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছেন।
বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত একটি বাড়িতে কাজ করছেন ৫০ বছর বয়সি উম্মে মুহাম্মদ। তিনি কিছু একটা তৈরি করছেন। পাশে কয়েকজন ক্ষুধার্ত শিশু খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, দেখতে ময়দার মতো হলেও এটা আটা বা ময়দা নয়। এটা হলো মসুর ডালের গুঁড়ি (বেসন)। এটা দিয়েই তিনি রুটি তৈরি করবেন ছোট নাতি-পুতির জন্য। যদিও এর রং সাদা নয় এবং স্বাদ রুটির মতো নয়, তবু এটা দিয়েই তাঁরা রুটি বানিয়ে খাচ্ছেন। আগে কখনো তারা আটা ছাড়া অন্য কিছুর রুটি না খেলেও এখন তারা তা খেতে পেয়ে নিরুপায়। তার নাতিরা পাস্তা খেতে পছন্দ করে। কিন্তু গাজায় পাস্তা পাওয়া যায় না এবং কখনোসখনো পাওয়া গেলেও তার মূল্য অতিউচ্চ। বেসনের শক্ত রুটি খেয়েই শিশুদের দিন কাটছে। অনেক সময় তাদের জন্য এই রুটিরও ব্যবস্থা করতে পারেন না।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গাজার পরিস্থিতিকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে সতর্ক করেছেন। জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের চেয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই শতাব্দীতে আমরা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজার দুর্বিষহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সাহায্যের প্রবাহ সমুদ্রের মতো হতে হবে। খাদ্য, পানীয়, ওষুধ ও জ্বালানি আসতে হবে বাধাহীন ঢেউয়ের মতো। তবেই এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন