শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ওমর ফারুক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ০২:৩১ এএম

যার কণ্ঠে ছিল সাহসের সুর ও সংগ্রামের শব্দ

ওমর ফারুক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ০২:৩১ এএম

যার কণ্ঠে ছিল সাহসের  সুর ও সংগ্রামের শব্দ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে বদরুদ্দীন উমর এক বিশেষ অধ্যায়ের নাম। তিনি ছিলেন এমন এক চিন্তক, যিনি জনপ্রিয়তার স্রোতে গা ভাসাননি। বরং সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি সামনে এনেছেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, গবেষণা ও লেখালেখি আমাদের ইতিহাসকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি দিয়েছে নতুন প্রজন্মের জন্য চিন্তার খোরাক। নব্বই বছরে পদার্পণ করা এই দার্শনিক-রাজনীতিবিদকে স্মরণ করা মানে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হওয়া।


বদরুদ্দীন উমরের শৈশব ও যৌবন কেটেছে এক সমৃদ্ধ পরিবারে। পিতা আবুল হাশিম ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই পরিবারিক পরিবেশেই তিনি পেয়েছিলেন জ্ঞানচর্চা ও রাজনৈতিক চেতনার দীক্ষা। 
উচ্চশিক্ষা শেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগেরও প্রতিষ্ঠাতা হন। একদিকে শিক্ষকতা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব উপস্থিতি। এই দুই ধারাই তাকে পরিণত করেছিল এক অনন্য মনীষীতে। ষাটের দশকে প্রকাশিত তার ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থগুলো তৎকালীন রাজনৈতিক সমাজে সাড়া জাগায়। এর পাশাপাশি তিনি ‘সংস্কৃতি’ নামে একটি সাময়িকী দীর্ঘ ৩০ বছর সম্পাদনা করেন, যা ছিল প্রগতিশীল চিন্তাচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। তার বহুমুখী লেখালেখির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত তিন খ-ের গবেষণা, ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’। এই গ্রন্থ তাকে এনে দিয়েছে ইতিহাস রচনার এক পথিকৃৎ মর্যাদা। রাজনীতির মঞ্চে তার ভূমিকা ছিল আপসহীন। পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পদ ছেড়ে তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় থেকে শ্রমিক-কৃষকের অধিকার নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি অকপটে বলেছেন, দেশভাগোত্তর সময়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাঙন কীভাবে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ক্ষয়ে দিয়েছে। তার এই স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে, তিনি কোনো প্রকার আড়াল বা অলঙ্করণ ছাড়া সত্যকে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন।


স্বাধীন বাংলাদেশেও বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক অগ্রণী সমালোচক কণ্ঠস্বর। তার রচনাগুলো, ‘ইমার্জেন্সি অব বাংলাদেশ’, ‘যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ’, ‘পশ্চাৎপদ দেশে গণতন্ত্রের সমস্যা’, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র’, ‘বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ প্রভৃতি, আমাদের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে ব্যাখ্যা করেছে গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সমকালীন সমাজে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য কিংবা সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব সব কিছুকেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তার চিন্তার মূলভিত্তি ছিল ইতিহাস ও রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক। তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো দেশের বিপ্লব কখনোই নকল করে আনা যায় না; সেটি জন্ম নিতে হবে দেশের নিজস্ব বাস্তবতা থেকে। তার ভাষায়, বাংলাদেশের বিপ্লব যদি হয়, তবে তা বাংলাদেশের মতো করেই হবে। এ জন্য প্রয়োজন চিন্তায় সাবালকত্ব, বাইরের তত্ত্ব অন্ধভাবে অনুকরণ নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে আন্তর্জাতিক মার্কসবাদী রাজনীতির মধ্যে এক স্বতন্ত্র অবস্থান দিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে বদরুদ্দীন উমর সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও আপসহীনতায় ছিলেন অনন্য। তার লেখনীতে যেমন ছিল নির্ভীক সত্যভাষণ, তেমনি সরাসরি কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। এজন্যই তার চিন্তাভাবনা কেবল গ্রন্থাগারে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং মাঠে-ঘাটে বাস্তব সংগ্রামের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। আজ যখন আমরা বাংলাদেশে বাম রাজনীতির দুর্বলতা, সমাজে মূল্যবোধের সংকট, কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতন দেখি, তখন বদরুদ্দীন উমরের চিন্তা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি দেখিয়েছেন, একজন বুদ্ধিজীবীর কাজ শুধু লিখে যাওয়া নয়, সত্য উচ্চারণের সাহস রাখা। 


বদরুদ্দীন উমর আমাদের বোধ, চিন্তা ও সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমলিন নাম। তিনি ছিলেন একাধারে বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক ও সংগ্রামী মানুষ। যিনি ভিন্নভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন, সত্য বলার সাহস জুগিয়েছেন। তার জীবন ছিল সমাজের জন্য, মানুষের জন্য। আজ তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার চিন্তা, তার লেখা, তার অঙ্গীকার আমাদের পথ দেখাতে থাকবে আগামীতেও। 
তার জীবন ও দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজচিন্তায় এখনো প্রয়োজন সত্যভাষী, আপসহীন মনীষীর। তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি হবেন অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল বাতিঘর। বদরুদ্দীন উমরের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!