দীর্ঘদিন ধরে গাজা যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করে আসছে কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র। দোহায় আলোচনাকারী হামাস প্রতিনিধিদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল কেবল কূটনৈতিক প্রচেষ্টারই অবমূল্যায়ন করেনি বরং সরাসরি কাতারের ভূখ-ে আঘাত হেনেছে বলে কাতারের অভিযোগ। প্রথমবারের মতো সরাসরি উপসাগরীয় মাটিতে আঘাত হেনেছে আঞ্চলিক দুই শক্তি। এ কারণেই চলতি বছরই ভেঙে গেছে উপসাগরীয় ধনী আরব রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাবোধ। জুনে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালে পাল্টা আঘাতে কাতারের একটি মার্কিন ঘাঁটিকে নিশানা করে তেহরান। এরপর এ সপ্তাহেই হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে টার্গেট করে দোহায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। প্রায় দুই বছর ধরে চলা গাজার যুদ্ধ এবার উপসাগরের দুয়ারে হাজির হয়েছে। তবে কাতার ঘোষণা করেছে, প্রতিশোধ নয় বরং ‘সমষ্টিগত প্রতিক্রিয়া’ দেখানো হবে। তবে সে সিদ্ধান্ত এখনো আলোচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি। তিনি বলেন, দোহায় আয়োজিত আরব ও ইসলামি সম্মেলনেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এরই মধ্যে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ আরব অংশীদার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) কাছ থেকে। হামলার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে দোহায় পৌঁছান। এরপর বাহরাইন এবং ওমান সফর করেন আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া সমন্বয়ের জন্য। শুক্রবার ইউএই তেল আবিবের কূটনীতিককে ডেকে পাঠিয়ে হামলাটিকে ‘নির্লজ্জ ও কাপুরুষোচিত’ বলে নিন্দা জানিয়েছে।
সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এরই মধ্যে দোহায় পৌঁছেছেন। সৌদি আরব এ হামলাকে ‘আক্রমণাত্মক ও হুমকিস্বরূপ পদক্ষেপ’ হিসেবে নিন্দা জানিয়ে কাতারকে পূর্ণ সংহতির আশ্বাস দিয়েছে। একই সঙ্গে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই ইসরায়েলকে তার কর্মকা-ের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। এ পরিস্থিতিতে কাতার চায় মুসলিম দেশগুলো এক প্ল্যাটফর্মে এসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বার্তা দিক।
সম্প্রতি দোহায় ইসরায়েলের চালানো বিমান হামলায় পাঁচ হামাস সদস্য এবং কাতারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন। তারা ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি যুদ্ধবিরতির খসড়া চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। হামলাটি চালানো হয় হামাস আলোচকদের আবাসিক ভবনে।
এদিকে কাতারের রাজধানী দোহায় হামলা চালাতে আশপাশের কোনো আরব দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করেনি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। তবে লোহিত সাগর থেকে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে সৌদি আরবের ওপর দিয়ে দোহায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বরাত বরাত দিয়ে গত শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে জেরুজালেম পোস্ট। এতে বলা হয়, ইসরায়েলি বিমানবাহিনী লোহিত সাগরে মোতায়েন করা যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে দোহায় অবস্থানরত হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালায়। একাধিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, লোহিত সাগরের আকাশসীমায় মোতায়েন ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর (আইএএফ) আটটি এফ-১৫ এবং চারটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এ অভিযানে অংশ নেয়। তবে কোনো ইসরাইলি বিমান আশপাশের আরব দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পাঠানো এক সাংবাদিক হামলার শিকার দোহার ভবনটি ঘুরে দেখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ভবনের মধ্যবর্তী তলা ও নিচতলার ডানদিকের অংশ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা আলী লারিজানি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘যৌথ অপারেশন রুম’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। দোহায় ইসরায়েলের হামলার পর কাতারে সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুসলিম নেতাদের একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দেয়। এই সম্মেলন থেকে ‘কাতার রাষ্ট্রের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব’ আনা হবে। আসন্ন সম্মেলনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আঞ্চলিক, বিশেষ করে আরব দেশগুলোকে ‘কার্যকর ফলাফল ছাড়াই’ সম্মেলন আয়োজনের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। এক্স-পোস্টে লারিজানি বলেন, একটি যৌথ অপারেশন রুম গঠন এই সত্তার (ইসরায়েল) মালিকদের উদ্বিগ্ন করার জন্য এবং তাদের আদেশ পরিবর্তন করার জন্য তাগাদা দিতে যথেষ্ট হবে।তিনি বলেন, মুসলিম বিশ্বের নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে, তা হবে ‘ইহুদি সত্তার পক্ষে আগ্রাসনের জন্য একটি নতুন লাইসেন্স প্রদানের সমান।’গত জুন মাসে ইসরায়েল ইরানেও আক্রমণ করেছিল। এর ফলে কয়েকদিন ধরে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চলে।
কাতারে হামাস কর্মকর্তাদের গুপ্তহত্যার জন্য স্থল অভিযান চালানোর যে পরিকল্পনা ইসরায়েল করেছিল, গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাতে সায় দেয়নি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েল ১৫টি যুদ্ধবিমান এবং ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, মোসাদ প্রধান ডেভিড বার্নিয়া কাতারে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। মোসাদ মত দিয়েছিল, এমন হামলা হলে কাতারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। মোসাদ স্থল অভিযানের পরিবর্তে সময় নিয়ে কাজ করার পক্ষে ছিল।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন