প্রতি বছরের মতো ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও দেশের কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনা মূল্যের নতুন বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগ সরকারের প্রশংসনীয় কর্মসূচি। কিন্তু এর আড়ালে যে চিত্র ভেসে উঠেছে, তা উদ্বেগজনক এবং ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিশেষ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে অতিরিক্ত চাহিদা দেখিয়ে ১ কোটি ৫৫ লাখ বই ছাপানো হয়েছে। গড়ে ৫০ টাকা দরে এসব বইয়ের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মানে, কেবল অতিরিক্ত চাহিদা দেখানোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে একটি চক্র। যা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক মারাত্মক অঘটন।
এ সিন্ডিকেটের খেলাটি খুব সরল। উপজেলা পর্যায়ের কতিপয় শিক্ষা কর্মকর্তা, কিছু ছাপাখানা মালিক এবং পরিবহন এজেন্সি মিলে এক ধরনের অঘোষিত চুক্তিতে নামে। তারা মাঠপর্যায় থেকে প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যার চেয়ে বেশি চাহিদা পাঠায়। প্রেসগুলো তখন সেই অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী বই ছাপানোর নামে বরাদ্দ নেয়। কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত চাহিদার বই সরবরাহ করেই কাজ শেষ করে। চালানে অতিরিক্ত বই দেখিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়, আর এই অতিরিক্ত বইয়ের মূল্য ভাগাভাগি করে নেয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ও প্রেস মালিক। কোথাও কোথাও পরিবহন এজেন্সির কর্মীরা অতিরিক্ত বই সংগ্রহ করে প্রেসে ফেরত বিক্রি করে দেয়। সব মিলিয়ে প্রতিটি ধাপেই দুর্নীতি ও প্রতারণার এক সুগভীর চক্র গড়ে উঠেছে। একদিকে যখন সরকার উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলছে, অন্যদিকে এই ধরনের লুটপাট গোটা শিক্ষানীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এখানে মূল সমস্যা শুধু প্রক্রিয়াগত ত্রুটি নয়; বরং দায়িত্বশীল পর্যায়ের অসাধু মানসিকতা। এনসিটিবি স্বীকার করেছে, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা যদি প্রকৃত চাহিদা যাচাই-বাছাই করে দিতেন, তবে এত বড় ধরনের লুটপাট সম্ভব হতো না। আবার প্রেস ও পরিবহন এজেন্সিগুলো যদি স্বচ্ছতা বজায় রাখত, তবে বাড়তি বইয়ের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া যেত না। অর্থাৎ শিক্ষা প্রশাসন, ছাপাখানা এবং পরিবহন, সবখানেই ছিল সমন্বিত দুর্নীতি।
এখন প্রশ্ন হলো, এই চক্রকে কীভাবে ভাঙা যায়? এনসিটিবির প্রতিবেদনে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে, বইয়ের চাহিদা সংগ্রহে বিশেষ সফটওয়ার তৈরি করে তা ডিজিটালভাবে মনিটরিং করা, যাতে কোনো কর্মকর্তা প্রকৃত চাহিদার বাইরে সংখ্যা যোগ করতে না পারেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সরাসরি জবাবদিহির আওতায় আনা, যাতে প্রকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা নিশ্চিত হয়। লটভিত্তিক মনিটরিং, পিডিআই (প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন) আরও কঠোরভাবে কার্যকর করা, এবং ইন্সপেকশন এজেন্টদের শুধু প্রেস নয়, সন্দেহজনক গুদাম পরিদর্শনের ক্ষমতা দেওয়া। একই সঙ্গে মনিটরিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব আরও বাড়াতে হবে, যাতে তারা কোনো চালানে সই দেওয়ার আগে প্রকৃত বইয়ের হিসাব মিলিয়ে দেখতে বাধ্য হন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। প্রতি বছর দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও প্রকৃত তদন্ত ও জবাবদিহির অভাবে এই চক্র ভাঙা যায়নি। জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, প্রেস মালিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা, এবং পরিবহন এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে।
আমরা আশা করি, আগামী শিক্ষাবর্ষে আর কোনোভাবেই অতিরিক্ত চাহিদার ফাঁদে পড়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হবে না। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরাতে হলে পাঠ্যবই ছাপায় নজরদারি জোরদার করা, দুর্নীতির ফাঁকফোকর বন্ধ করা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত কারার কোনো বিকল্প নেই।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন