মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মাইনুল হক ভূঁঁইয়া

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ১১:৫০ পিএম

ঘন ঘন লাইনচ্যুতিতে প্রশ্নবিদ্ধ রেলসেবা 

মাইনুল হক ভূঁঁইয়া

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ১১:৫০ পিএম

ঘন ঘন লাইনচ্যুতিতে প্রশ্নবিদ্ধ রেলসেবা 

ঘন ঘন লাইনচ্যুতিতে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণমাধ্যম রেলসেবা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জয়পুরহাট ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় পরপর তিনটি লাইনচ্যুতির ঘটনায় বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে আলোচনা। যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের মনে এমন প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছেÑ রেলপথ বিভাগ কী জেগে জেগে ঘুমায়। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধীন দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এআরআইর গবেষকগণ মনে করেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার নেপথ্যে থাকে কোনো না কোনো বড় গাফিলতি। কখনো তা প্রযুক্তিগত ত্রুটি, কখনো মানবিক ভুল। তাদের মতে, এভাবে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকলে যাত্রীদের মাঝে বিপজ্জনক বার্তা যাবে- রেল ভ্রমণে তৈরি হবে অনীহা। এতে করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। সংস্থাটির একজন গবেষকের পরামর্শ, এখনই নজর না দিলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা এক সময় মুখ থুবড়ে পড়বে। নথি থেকে দেখা যায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কম করে হলেও ৪৫টি ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে চলতি বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩১ লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। 

এ সব ঘটনার অধিকাংশের পেছনে ছিল রেল ট্র্যাকের দুর্বলতা এবং রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি। বিগত জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রেল ভয়াবহ অগ্নিকা-ের শিকার হয়। কোচের পাশাপাশি সে সময় বিভিন্ন রেল স্টেশনে সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। কোথাও কোথাও রেল লাইন উপড়ে ফেলার মত ঘটনারও খবর পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় প্রায় ২২ কোটি ৩ লাখ ৮ হাজার টাকার ক্ষতি হয় রেলের। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলিয়ে এই হিসাব নিরুপণ করে রেল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও দেশের দুই অঞ্চলের রেললাইনের অবস্থা আগে থেকেই নাজুক।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ রেল পথের স্থানে স্থানে স্লিপারের অবস্থা বেহাল। কোথাও কোথাও স্লিপার সমান হয়ে গেছে। কোনো কোনো লাইনে পাথর নেই বললেই চলে। বিশেষ করে রেলগেটগুলোর স্লিপারের করুণ অবস্থা। এগুলোর ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করে স্লিপারের রফাদফা হয়ে গেছে। আবার কোন লাইনে নাট-বল্টু ঢিলেঢালা। এ অবস্থায়ই রেল চলেছে অনবরত। তার ওপর যুক্ত হয়েছে চালকদের অনভিজ্ঞতা এবং গতি সীমার প্রতি উদাসীনতা। ব মিলিয়ে নাজুক প্রতিকূলতা পেরিয়ে রেল তার যাত্রী সেবা অব্যাহত রেখেছে।

আশ্চর্যের বিষয়, রেলপথ বিভাগ বরাবরই জেগে জেগে ঘুমিয়েছে এতকাল। তাদের এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র মাথ্যাব্যথা লক্ষ্য করা যায়নি। ঘটনা ঘটলেই তারা লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করে দায় সারতে চেয়েছে। সেসব কমিটির রিপোর্টও কখনো আলোর মুখ দেখেনি। তার চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয়, ঘটনার নেপথ্য কারণ কখনো খোঁজা হয়নি। ফলে ছোট ছোট ঘটনা ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে। ময়মনসিংহ, ঈশ^রদী ও কমলাপুরের পর জয়পুরহাট এবং আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রতিক লাইনচ্যুতির ঘটনা সে দিকেই অঙ্গুলি হেলন করে। গত ৭ সেপ্টেম্বর ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’ লাইনচ্যুতির ঘটনাটি পশ্চিমাঞ্চল রেলের খামখেয়ালিপনা ও ওদাসীন্যের  এক ভয়াবহ নজির। 

জানা যায়, ওইদিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকে ছেড়ে আসা এক্সপ্রেস ট্রেনটি উপজেলার ভদ্রকালী চক্রঘুনাথ এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। যাত্রীরা তখন আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, হলহলিয়া রেল ব্রিজের পূর্বপাশের লাইনটি ভাঙা ছিল। ফলে ট্রেনটি বিকট শব্দে লাইনচ্যুত হয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে  চলে যায়। এ ঘটনায় ঢাকা এবং দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পর পার্বতীপুর তেকে উদ্ধারকারি রিলিফ গিয়ে লাইনচ্যুত বগি উদ্ধার ও মেরামত করলে ছয় ঘন্টা পর ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার পর  রেল যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হয়। লাইন সংস্কারে গাফিলতি ও অবহেলাই দুর্ঘটনার কারণ বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্ত রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রকৌশলী কিংবা কর্মচারিদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এমনকি কাউকে কোন কারণ দর্শাতেও বলা হয়নি। 

এর আগে গত ৯ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা এলাকায় ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ লাইনচ্যুত হয়। আধাঘণ্টার পর একই স্থানে ট্রেনটির লাইনচ্যুতি ঘটে। গত ১০ মে শনিবার আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে ঘটে আরেক লাইনচ্যুতির ঘটনা। ওইদিন দুপুরে কন্টেইনারবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এর আগে গত ৭ জুন ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ৭৯৩ নম্বর আপ পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও একটি বগি ইশ^রদী বাইপাস স্টেশনে লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় স্টেশন মাস্টারের মারাত্মক অবহেলা ও খামখেয়ালিপনার তথ্য উদঘাটিত হয়। রেলের পাকশী বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, পয়েন্ট পরিবর্তন না করে স্টেশনমাস্টার ট্রেনটিকে সবুজ সংকেত দেওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ইঞ্জিনের ৬টি চাকা ও প্রথম বগির দুইটি চাকা লাইনচ্যুত হয়। পরে ঈশ^রদী লোকোশেড থেকে রিলিফ ট্রেন এসে এটি উদ্ধার করলে প্রায় এক ঘণ্টা পর ট্রেনটি আবার যাত্রা শুরু করে। তা ছাড়া ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে পরপর দুটি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। ২০২৩ সালে কিশোরগঞ্জের আন্তনগর এগারোসিন্ধুর গোধূলী ট্রেনটি ইঞ্জিনের পরিবর্তন করার সময় জগন্নাথপুর রেলক্রসিং অতিক্রমকালে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দিলে তিনটি বগি উল্টে যায়।

এতে প্রায় ১৭ জন নিহত এবং আহত হন ৭৫ জনেরও বেশি যাত্রী। ২০২৪ সালের ২৫ অক্টোবর রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনের আউটার সিগন্যাল এলাকায় পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এটি উদ্ধারে প্রায় সাত ঘণ্টা লাগায় ট্রেনের ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এর একদিন আগে ২৪ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের একটি লোকাল ট্রেন গোপিবাগে লাইনচ্যুত হয়। অপরদিকে যখন এ প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুত চলছিল, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরও একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে।  

জানা গেছে, সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ‘কালনী এক্সপ্রেস’  বেলা ১১টা নাগাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন ছাড়ে। অনতিদূরে তালশহর এলাকায় পৌঁছলে বাফার (রেলের সামনে-পেছনে যুক্ত যন্ত্রাংশ) খুলে ট্রেনটির পাঁচটি বগি আলাদা হয়ে যায়। তবে আরেকটি অতিরিক্ত লাইন থাকায় রেল চলাচলে বিঘœ ঘটেনি।

লাইনচ্যুতির কারণ:

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে রেল লাইনচ্যুতির পেছনে। এর মধ্যে রেললাইন ভেঙে যাওয়া, ফাটল ধরা বা সঠিকভাবে বসানো না হলে ট্র্যাক অস্থির হওয়া, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ট্রাক দুর্বল হয়ে পড়া, ট্রেনের চাকার বেয়ারিং বিকল হয়ে গেলে অথবা অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত গতিতে কোনো বাঁকের ওপর ট্রেন চালালে কেন্দ্রাতিগ বলের কারণে, ট্রেনে মালামাল সঠিকভাবে লোড না করলে ওজনের অসম বণ্টন হওয়া, অন্যান্য বস্তু কিংবা ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণ এবং চালক অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ভুল, অসাবধানতা অথবা খামখেয়ালির কারণেও ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটতে পারে।

এদিকে এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূলত এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। সবার আগে দরকার দুর্বল স্লিপার বদলে দেওয়া এবং লাইনে পাথর দেওয়া। ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনগুলোও বদলে ফেলা প্রয়োজন’। 

রেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:

সার্বিক বিষয়ে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। প্রধান প্রকৌশলী তানভিরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঘন ঘন লাইনচ্যুতির কারণ কীÑ আমার বলা ঠিক হবে না। তবে এটুক বলতে পারি, কারণ নিরূপণের কাজ চলছে। এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিভিন্ন সমস্যার কারণে রেলের লাইনচ্যুতি ঘটতে পারে। এর মধ্যে ইঞ্জিনের হুইলের সমস্যা, লাইনের সমস্যা, ভুল সিগন্যাল এবং ইঞ্জিনের ত্রুটিও থাকতে পারে’। তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক লাইনচ্যুতির ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই সুনির্দিষ্টভাবে এর কারণ জানানো যাবে।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!