শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এম এ হোসাইন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫, ০১:১২ এএম

ট্রাম্প-মোদি শুল্ক যুদ্ধ: আশার আড়ালে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

এম এ হোসাইন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫, ০১:১২ এএম

ট্রাম্প-মোদি শুল্ক যুদ্ধ: আশার আড়ালে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি যখন হাত মেলান, বলেন ‘সীমাহীন সম্ভাবনা’ আর তাদের বন্ধুত্বের দৃঢ়তার ঘোষণা দেন, তখন দৃশ্যপট দেখে মনে হয় পৃথিবী যেন এক নতুন বাণিজ্য অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তবে সেই সৌহার্দ্যরে আড়ালে লুকিয়ে আছে কঠিন বাস্তবতা। দুই নেতার প্রকাশ্য হাসিমুখ আর আশাবাদী বার্তার ভেতরে জমে আছে গভীর অমিল, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে।

ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্টাইল চিরকালই ভিন্ন। নিজেকে তিনি ‘ডিল মেকার’ হিসেবে উপস্থাপন করতে ভালোবাসেন। তাই আলোচনার প্রেক্ষাপট যত জটিল হোক না কেন, তিনি আত্মবিশ্বাসের সুরেই কথা বলেন। অন্যদিকে মোদি ভারতের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে মরিয়া, এক উদীয়মান শক্তি, যা বিশ্ব রাজনীতিতে অপরিহার্য। এজন্য তার কাছে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি ও অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সম্পর্কের উপর ভারি ছায়া ফেলছে শুল্ক, নিষেধাজ্ঞা ও পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

তবে সৌহার্দ্যরে ভাষার আড়ালে রয়ে গেছে তীব্র মতপার্থক্য। শুল্কনীতি, নিষেধাজ্ঞা আর পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ওপর দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। ট্রাম্প আমলে আমেরিকা দ্বিগুণ জোরে শুল্ক কূটনীতিতে নেমেছে। ভারতীয় আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপানো হয়েছে। এই শাস্তি ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্কের কারণে। ট্রাম্পের কাছে এটি কেবল বাণিজ্য ভারসাম্যের প্রশ্ন নয়; বরং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মস্কোর কৌশলের টুটি চেপে ধরার প্রচেষ্টা। কিন্তু মোদির কাছে এই শুল্কনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর ভিত্তিতেই ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে। ট্রাম্পের শুল্ক চাপ আসলে সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

এই পার্থক্য শুধু অর্থনীতির নয়, বরং এক গভীর বাস্তবতার প্রতিফলন। শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতা যতই আশাবাদী শুনাক, বাণিজ্য চুক্তি কেবল বাণিজ্য নয়; এর ভেতরে থাকে রাজনীতি, শক্তি ও জাতীয় স্বার্থ।

ভারতের নীতি-বিভাজন বুঝতে হলে ইতিহাসে ফিরতে হয়। স্বাধীনতার পর নেহরু নেতৃত্বাধীন ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথে হাঁটে। কৌশলগতভাবে ভারত চায়নি শীতল যুদ্ধের কোনো শক্তি-গোষ্ঠীর ফাঁদে আটকা পড়তে। বাস্তবে এর মানে ছিল মস্কোর ঘনিষ্ঠতা যা অস্ত্র, জ্বালানি ও কূটনৈতিক সমর্থনের বার্তা। আজও সেই ঐতিহ্যের ছাপ ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অটল।

বর্তমানে সস্তা দামে বিক্রি হওয়া রুশ তেল ভারতের প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ট্যাঙ্ক থেকে যুদ্ধবিমান, ভারতের সামরিক শক্তির মেরুদ- এখনো রুশ অস্ত্রনির্ভর। ওয়াশিংটনের চাপে হঠাৎ মস্কো থেকে সরে আসা মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং চীনের সঙ্গে তীব্র নিরাপত্তাজনিত দ্বন্দ্বের সময়ে নিজেকে দুর্বল করে ফেলা।

এ কারণেই ট্রাম্পের শুল্কের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ উল্টো ফল দিতে পারে। ছোট অর্থনীতি হলে ভিন্ন কথা, কিন্তু ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইন্দো-প্যাসিফি কৌশলে  অপরিহার্য অংশীদার। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ভারতের হাতে সেই সুবিধাই দেয় যার একদিকে রয়েছে ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা, অন্যদিকে রাশিয়ার জ্বালানি ও অস্ত্র ব্যবহার। মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি আসলে ভারতীয় রাষ্ট্রকৌশলকেই ভুলভাবে বোঝা।

ইতিহাস এখানে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন যখন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তখন মস্কো ভারতের কূটনৈতিক সঙ্গী হয়ে উঠে, জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে দিল্লিকে অবরুদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচায়। এমন স্মৃতি সহজে মুছে যায় না। ভারতীয় নেতাদের কাছে রাশিয়া কেবল অর্থনৈতিক অংশীদার নয়, বরং সংকট মুহূর্তের কৌশলগত আশ্রয়দাতা। ট্রাম্পের বিস্তৃত শুল্ক এজেন্ডা বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীন ও ভারতের পণ্যের ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। তার যুক্তি, এভাবে রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থনৈতিক সমর্থন বন্ধ করা যাবে। পরিকল্পনাটি সাহসী হলেও সাহস সবসময় প্রজ্ঞার সমার্থক নয়। ভারতকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে একই পাল্লায় মেপে দিল্লির ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ওয়াশিংটন হয়তো এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেই দূরে ঠেলে দেবে।

এরূপ পরিস্থিতিতে ভøাদিমির পুতিন সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি মার্কিনিদের সমালোচনা করে বলেছেন, ভারত ও চীনের সঙ্গে ‘ঔপনিবেশিক সুরে’ কথা বলা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের মতো দেশ, যারা উপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বহন করে, তারা এমন ভাষার প্রতি স্বভাবতই সংবেদনশীল। ট্রাম্পের হুমকি সেই ক্ষতকে আরও উসকে দিতে পারে। এতে রাশিয়া ও চীনের প্রচার কৌশল আরও শক্তিশালী হবে, পশ্চিমা দেশগুলো আসলে আধিপত্য চায়, প্রকৃত অংশীদারিত্ব নয়।

ফলত ট্রাম্পের শুল্ক-কূটনীতি উল্টো ফল দিতে পারে। মস্কো-বেইজিং থেকে ভারতকে দূরে টানার বদলে হয়তো কাছে ঠেলে দেবে। বাণিজ্য দিয়ে চাপ সৃষ্টি করলে দ্রুত ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আস্থাভিত্তিক সম্পর্ক গড়া যায় না।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতে কি ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়? হয়তো পুরোপুরি নয়। দুই নেতা-ই প্রতীকের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত। মোদির প্রধান লক্ষ্য দেশে শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরা, তিনি কখনো বিদেশি চাপের কাছে মাথা নত করেন না। ট্রাম্পের অগ্রাধিকার ভিন্ন, তিনি এমন এক চুক্তি চান, যা তার প্রচারণায় তুলে ধরতে পারবেন। এই ভিন্ন লক্ষ্য বড় ধরনের সমঝোতাকে অনিশ্চিত করে। সম্ভবত তারা সীমিত, কিন্তু কৌশলগতভাবে সাজানো চুক্তিতেই পৌঁছাবেন, যেমন আমেরিকান প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রয় বৃদ্ধি, ভারতের কৃষি ও ডিজিটাল খাতে মার্কিন কোম্পানির প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, কিংবা সীমিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।

এসব পদক্ষেপ মৌলিক দ্বন্দ্ব সমাধান করবে না। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা-নির্ভর বাণিজ্যনীতি ও ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির কৌশলগত তাগিদ একই জায়গায় মিলবে না। তবে উভয় পক্ষকেই সাময়িক সাফল্য দাবি করার সুযোগ দেবে। ট্রাম্প দেখাতে পারবেন যে শুল্ক কার্যকর। মোদি প্রমাণ করতে পারবেন যে ভারত তার অবস্থানে থেকেও ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ।

তবু ভুল হিসাবের ঝুঁকি থেকেই যায়। ট্রাম্পের একগুঁয়ে ধারা আপসের জায়গা কমিয়ে দেয়। তিনি যদি চান ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দিক, তবে আলোচনা ভেস্তে যাবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেকোনো ছাড়কে ‘বিদেশি শক্তির কাছে নতি স্বীকার’ বলে আক্রমণ করবে। তখন মোদির বাধ্য হয়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এর প্রভাব শুধু প্রতীকী হবে না; ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা চীনের মোকাবিলায় উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে।

ট্রাম্প-মোদি শুল্ক যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিশ্বব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। এক সময় বাণিজ্য ছিল জাতিগুলোর সেতু, এখন তা প্রায়শই অস্ত্র। জোটগুলোও বদলে গেছে। আর কেবল অভিন্ন মূল্যবোধের ওপর দাঁড়ায় না, বরং সমঝোতা, চাপ আর প্রয়োজনের ভিত্তিতে দাঁড়ায়। ভারত, এর উজ্জ্বল উদাহরণ, জ্বালানির জন্য রাশিয়ার দিকে তাকায়, বাজারের জন্য পশ্চিমের দিকে, আর নিরাপত্তার জন্য নিজের দিকে।

সবচেয়ে ভালো হয়তো বা হতে পারে, তারা এক অস্থায়ী শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাবে। তা হয়তো ভাঙন ঠেকাবে, কিন্তু মূল দ্বন্দ্ব মেটাবে না। কূটনৈতিক আশাবাদ পরিবেশকে নরম করতে পারে, কিন্তু দ্বন্দ্ব লুকাতে পারে না। আমেরিকা বাণিজ্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, ভারত খোঁজে ভারসাম্য, আর এতে পুতিন কৌশলগত লাভ খুঁজে নেন। এই অনিশ্চিত ত্রিভুজেই বিশ্বব্যবস্থা নতুনভাবে রূপ নিচ্ছে।

যদি ছোট কোনো চুক্তি হয়, ট্রাম্প ও মোদি সেটিকে ঐতিহাসিক বলে প্রচার করবেন। যদি আলোচনা ভেঙে যায়, প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লির বাইরেও। তা প্রকাশ করবে আমেরিকার শুল্কনির্ভর কূটনীতির সীমাবদ্ধতা, পশ্চিমা শিবিরে বিভাজনকে গভীর করবে এবং ভারতকে আরও দৃঢ়ভাবে নিজের স্বাধীন কৌশলগত পথে এগিয়ে দেবে।

এম এ হোসাইন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!