বাংলাদেশের কৃষি মৌসুমে সেপ্টেম্বর একটি বিশেষ সময়। বর্ষা শেষে যখন বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে আসে, তখনো দেশের অনেক জায়গায় পানি জমে থাকে। আবার এ সময় তাপমাত্রা গড়ে ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা ৭৫-৮৫ শতাংশের মধ্যে থাকে। ফলে মাটি যেমন- শুকাতে শুরু করে, তেমনি আর্দ্র পরিবেশ ফসলের জন্য ঝুঁকিও তৈরি করে। তবে এই সময় যদি কৃষকেরা জমি ও পরিবেশ অনুযায়ী সঠিক ফসল বেছে নিতে পারেন, তাহলে ফলন ও লাভ দুটোই নিশ্চিত করা সম্ভব। এ বিষয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান। তুলে ধরেছেন মিনহাজুর রহমান নয়ন।
মৌসুমের প্রধান ভরসা
সেপ্টেম্বর মাসে আমন ধান রোপণের সঠিক সময়। বোরো ধানের মতো প্রচুর পানি এর প্রয়োজন হয় না, তাই কৃষকের খরচও তুলনামূলক কম পড়ে। এই সময়ে ধান লাগালে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ফসল ওঠে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেসব জমিতে পানি জমে আছে সেখানে বিরি ধান-৫৬ ও বিরি ধান-৫৭ জাত চাষ করা উচিত, কারণ এগুলো বন্যা সহনশীল। প্রতি একরে প্রায় ১৫-২০ কেজি বীজ ব্যবহার করলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। ড. মশিউর রহমানের ভাষায়, আমন ধান দেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য এখনো অপরিহার্য।
সবজি ফসলের সম্ভাবনা
আমন ধানের পাশাপাশি সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন সবজি ফসলও লাগানো যায়, যা কৃষকদের দ্রুত আয় এনে দেয়। যেমন কাঁকরোল এই সময়ের একটি সম্ভাবনাময় ফসল। সেপ্টেম্বরে কাঁকরোল লাগালে নভেম্বরেই ফলন পাওয়া যায়। চাহিদা বেশি থাকায় দামও ভালো পাওয়া যায় এবং তুলনামূলকভাবে রোগবালাই কম হয়। একইভাবে লাউ চাষও লাভজনক। সেপ্টেম্বরে বীজ বপন করলে অক্টোবর-নভেম্বরে বাজারে সরবরাহ করা যায়। লাউ দ্রুত ফল দেয়, একবার ফলন শুরু হলে প্রতি তিন থেকে চার দিন পরপর ফল পাওয়া সম্ভব। মরিচও সেপ্টেম্বরে লাগানো যায়, যা দীর্ঘ সময় ধরে কৃষকদের আয়ের উৎস হয়ে থাকে। একেকটি মরিচগাছ থেকে বছরে প্রায় এক থেকে দেড় কেজি মরিচ পাওয়া যায়, আর বাজারে মরিচের দাম সবসময়ই আকর্ষণীয়।
স্বল্পমেয়াদি ফসলের চাহিদা
ধনিয়া পাতা সেপ্টেম্বরে চাষ করার মতো একটি স্বল্পমেয়াদি ফসল। এ সময় ধনিয়া পাতার বাজার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়, কারণ মানুষ বেশি করে রান্নায় ব্যবহার করে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বীজ বপন করলে মাত্র ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই প্রথম ফসল তোলা যায়। ধনিয়া পাতার একটি মৌসুমে ছয় থেকে সাতবার পর্যন্ত তোলা সম্ভব, যা কৃষকদের নিয়মিত ও নিশ্চিত আয় নিশ্চিত করে। জমিতে নিয়মিত পানি দিতে হয়, তবে খেয়াল রাখতে হয় যেন পানি জমে না থাকে। এভাবে অল্প সময়ে ভালো মুনাফা করার সুযোগ তৈরি হয়।
কৃষকের সাধারণ ভুল ও করণীয়
অনেক সময় কৃষকেরা কয়েকটি ছোট ভুলের কারণে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হন। সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বড় ভুল হলো জমিতে পানি জমিয়ে রাখা। বর্ষা শেষে জমিতে অতিরিক্ত পানি থাকলে বীজ নষ্ট হয়ে যায়। আরেকটি সাধারণ ভুল হলো অতিরিক্ত সার প্রয়োগ। অনেকেই মনে করেন বেশি সার মানেই বেশি ফলন, কিন্তু বাস্তবে সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করলেই ভালো ফসল পাওয়া যায়। এছাড়া এই সময়ে আর্দ্রতা বেশি থাকায় রোগবালাই দ্রুত ছড়ায়, তাই নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করে রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আধুনিক কৃষির দিকে অগ্রসর হওয়া অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের মতে,
কৃষকদের শুধু প্রথাগত নিয়মে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এখন নানা আধুনিক জাত ও কৃষি প্রযুক্তি এসেছে, যা কাজে লাগালে উৎপাদন বহুগুণে বাড়বে। কৃষিবিদরা সবসময় নতুন
নতুন সমাধান নিয়ে আসছেন, কিন্তু কিছু কৃষক এখনো সেই সুযোগ গ্রহণ করছেন না। ফলে তাদের উৎপাদনও সীমিত রয়ে যাচ্ছে। তিনি পরামর্শ দেন, কৃষকরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করলে শুধু নিজেদের আয় বাড়বে না, বরং দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনও অনেক বাড়বে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন